Old Muslimians
যতটুকু মনে পড়ে

Mar 06, 2024

যতটুকু মনে পড়ে



১৯৩৩ ইংরেজীতে আমি যখন বহু চেষ্টার পর চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের কাজে যোগদান করি তখন চট্টগ্রামের বুকে এখানে সেখানে সন্ত্রাসবাদের ফুলিঙ্গ ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে উঠতেই বৃটিশের কামান ভীষণ গল করে গোলা বারুদের অগ্নি - উৎপাত ঘটাত তাঁর সঙ্গী নেতাদের ধরবার জন্য গ্রামে গ্রামে ফাঁদ পাতা হল । পটিয়া ও বোয়ালখালী থানার সমগ্র অঞ্চলে ও রাউজানের অন্তর্গত কোয়েপাড়া ও নয়াপাড়া গ্রামে ছদ্মবেশী গুপ্ত পুলিশের ছড়াছড়ি ত ছিলই , তদুপরি প্রধান সন্দেহভাজন কেন্দ্রসমূহে গুর্খা ও মিলিটারী পুলিশের আড্ডাও বসানো হয়েছিল । আশে পাশে নিরীহ অধিবাসীদের মনে আতঙ্ক ছড়ানো ব্যতীত তাদের বিশেষ কিছু করবার ছিল না । কারণ যে সব সন্ত্রাসবাদী নেতা ধরা পড়েছিলেন তাঁরা দেশবাসী কুলাঙ্গারদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই বৃটিশের কবলে পড়েন । এদের কারসাজিতে কত নিরীহ নর - নারী যে নিগৃহীত হয়েছে তার সংখ্যা নেই । আমি মুসলিম হাইস্কুলে এসে কিছুদিন স্ত্রী - পুত্রকে পটিয়ার বাড়ীতে রেখে শহরে থাকতাম । শনিবারে বাড়ী যেতাম । আমার বাড়ী পটিয়ার খাসমহাল অফিসের কম্পাউণ্ড সংলগ্ন খাসমহালের উপর দিয়েই তখন আমরা চলাফেরা করতাম । একদিন ভোর রাতে আমার বাড়ীর চারিপাশ গুর্খা ও মিলিটারী পুলিস ঘেরাও করে মুসলমান মেয়েরা বিশেষতঃ গরীব লোকের স্ত্রী - কন্যারা দু'কাপড় পরত । সাদা বা রঙীন চওড়া পাড়যুক্ত শাড়ী পরত না । অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ও শিক্ষিত লোকদের বাড়ীর মেয়েরা শাড়ী পরত । আমাদের ওখানে সাদা শাড়ী পরা আকারে প্রকারে কল্পনা দত্তের মত একটা স্ত্রীলোক গুপ্ত পুলিশের নজরে পড়ে । কারণ আমার স্ত্রী কড়াকড়ি অবরোধ প্রথা মেনে চলতেন না । গুপ্তচরদের হয়ত মনে হয়েছিল মুসলমান পাড়ায় কল্পনা দত্ত এসে আশ্রয় নিয়েছে । এ খবর মিলিটারী ক্যাম্পে পৌঁছাতে তারা এক ভোর রাতে এসে বাড়ী ঘেরাও করে । আমার স্ত্রী যখন সকালে ঘরের বাইরে উঠানে চলাফেরা করছিলেন , তখন কয়েকজন গুর্খা ও কয়েকজন পুলিশ গিয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলে । তিনি ভয় পেলেও তা দেখাচ্ছিলেন না । দেশ বিদেশে আসা - যাওয়ার ফলে তাঁর সাহস ও বুদ্ধি স্বাভবতঃই অন্যান্য গ্রাম্য মেয়ের চেয়ে বেশী ছিল । দেখতে দেখতে বাড়ীর আশেপাশের লোকজন ও খাসমহাল অফিসের পরিবার নিয়ে বাস করেন এমন কয়েকজন কর্মচারী এসে ব্যাপার কি জানতে চান । ইতিমধ্যে দেশীয় পুলিশ বাংলা ভাষায় আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আরম্ভ করেছে । তারা তাঁকে কল্পনা দত্ত বলেই ধরে নিয়েছিল । তখন তিনি দৃঢ় প্রতিবাদ করে জানালেন যে , তিনি কল্পনা দত্ত নন , তিনি মুসলমান এবং এক সরকারী কর্মচারীর স্ত্রী । তাঁর স্বামীকে নিকটস্থ খাসমহাল অফিসার ও থানার দারোগারা চিনেন । ইতিমধ্যে খবর পেয়ে খাসমহাল অফিসার ও থানার দারোগাও এসে পড়ে ছিলেন । তাঁরা মিলিটারী দলের কর্তাকে বুঝিয়ে বলতেই তারা জাল গুটিয়ে চলে গেল । কিন্তু নিজেদের ব্যবহারের জন্য কোনরূপ দুঃখ প্রকাশ করল না । এ সব গুর্খা ও মিলিটারীদের দুর্ব্যবহারের অনেক দৃষ্টান্ত আছে । সে বছর গ্রীষ্ম - বন্ধে আমি বাড়ীতে ছিলাম । একদিন সকালে চটি পায়ে , লুঙ্গি পরে ও গেঞ্জি গায়ে আমার এক চাচার সঙ্গে গল্প করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবে খাস মহালের রিজার্ভ ট্যাঙ্কের সামনে একটা গরুর গাড়ীতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলাম । ওটা যে গুর্খা প্রহরাধীন মিলিটারী পানীয় জলের গাড়ী আমার খেয়াল ছিল না । হঠাৎ এক গুর্খার অভদ্র চীৎকারে আমি চকিতে ফিরে দেখি সে ভোজালি হাতে আমাকে মারতে আসছে । অনেক অনুনয় বিনয় করে তার হাত থেকে রেহাই পেলাম বটে , কিন্তু সেদিন থেকে বৃটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে ষোল আনা আক্রোশে মন পূর্ণ হয়ে গেল । আর একজন মিলিটারী পুলিসের আচরণ আমাকে একেবারে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল । সে অনেক বছর পরের কথা । ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি । চট্টগ্রাম তখন মিলিটারীতে ভর্তি । এ সব টমিদের শায়েস্তা রাখবার জন্যে মিলিটারী পুলিস বড় বড় রাস্তায় টহল দিয়ে ফিরত । একদিন আন্দরকিল্লা রোডে বক্সিরহাট বিট ও লালদীঘির মাঝামাঝি স্থানে আমি এক উকিল বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম । তাঁর হাতে সাইকেল ছিল । তখন দু'জন টমি সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল । হাতে সইকেল - ধরা বন্ধুটিকে দাঁড়ানো দেখে ওদের একজন আমাদের দু'জনকে এমন ভাবে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল যেন আমরা তাদের মহাশত্রু । মৃদু আপত্তি করাতে তারা তেড়ে মারতে আসে আর কি ! অথচ আমাদের কি দোষ আমরাও বুঝলাম না , তারাও বুঝিয়ে দিল না । মন তিক্ততায় ভরে গেল । তখন আমি শহরে একমাত্র সরকারী স্কুলের হেডমাষ্টার এবং জিলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কমিশনারের সাথে দেশের নানা সমস্যা নিয়ে বিশেষভাবে জড়িত । অথচ সাধারণ একজন বৃটিশ সৈন্য আমাদের সঙ্গে যা তা ব্যবহার করল । তখনই ঐ গুর্খার কথা মনে পড়ল এবং নূতন করে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে মন বিষিয়ে উঠল । বাস্তবিক বৃটিশ সাধারণ সৈন্য ও কর্মচারীদের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে বিদেশী সরকারের প্রতি দেশের লোকের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা ঘনীভূত হয়ে তাদের এত তাড়াহুড়া করে ভারত ত্যাগে বাধ্য করেছিল । ১৯৩৩ সালের শেষের দিক হতে দ্রব্যমূল্যের নিম্নগতি বন্ধ হয়ে উর্দ্ধদিকে উঠবার লক্ষণ দেখা দিল । কৃষকেরা ইতিমধ্যেই পানির মূল্যে ধান পাট বিক্রয় , মহাজনদের কারসাজিতে জমিজমা বন্ধক ও নীলামে হারিয়ে অতি কষ্টে জীবন ধারণ করছিল । এ সময়ে ভারতের সর্ব্বত্র যেমন কৃষকদের দুর্দশার সীমা ছিল না , তেমনি মধ্যে মধ্যে তাদের রোষাগ্নি জ্বলে উঠার দৃষ্টান্তও বিরল ছিল না । বাংলাদেশের কৃষক পার্টির সংগঠনী নেতা হিসেবে জনাব ফজলুল হকের তখন খুব নাম - ডাক । তিনি মহাজনদের কবল থেকে তাদের রক্ষা করবার জন্য বিশেষ সচেষ্ট হলেও লীগ নেতারাও এ বিষয়ে নিশ্চেষ্ট ছিলেন না । এ দু'দলের আগ্রাহাতিশয্যে ঋণ - সালিশী বোর্ডের পরিকল্পনা বাস্তবে পরিণত হয় । শিক্ষা - করের প্রবর্তন দ্বারা প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং জিলা শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করে এর উপর বোর্ডের সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা ছিল । ঋণ সালিশী - বোর্ড স্থাপন , শিক্ষা - কর প্রবর্তন এবং অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে আইন প্রণয়নের সময় প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ হিন্দু - সদস্য বিরোধিতা করেছিলেন । কারণ এ দু'আইনই তাদের স্বার্থহানিকর ছিল । খাজা নাজিম উদ্দীন সাহেব নিজে বঙ্গদেশের প্রধানতম ভূস্বামী হয়েও এ দু'বিলেই তাঁর পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন । রাজনৈতিক কুটিলতায় দল পাকানোর নিপুণতার এবং নেতা হিসেবে দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেবার দক্ষতায় তাঁর দীর্ঘ কর্ম্মময় জীবন চমকপ্রদ না হলেও ধর্মনিষ্ঠা ও সরলতা , আদর্শ অনুশীলনের ঐকান্তিক বাসনা এবং সকলের শুভ হোক - এ কামনায় স্যার নাজিম উদ্দীন সাহেব সর্বশ্রেণীর লোকের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন । অসমসাহসী , অসাধারণ প্রতিভাবান লোকের সংখ্যা চিরদিনই সংসারে অতি নগণ্য । কিন্তু তা বলে সৎলোকের সংখ্যাও সংসারে খুব বেশী নয় । তিনি মহৎ বা বিরাট না হলেও একান্তভাবে সৎ ছিলেন । To be good is no less then to be great . এ সৎলোকটির তিরোধানের পর দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিনা সঙ্কোচে সালাম দেওয়া যায় তেমন নেতা আর চোখে পড়ে না । ঋণ সালিশী - বোর্ড স্থাপনের দ্বারা দেশের কৃষককুল যে মহাজনদের অজগরগ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে শুধু তা নয় মহাজন , জমিদার ও ধনিক - বণিক শ্রেণীও অবশ্যম্ভাবী সর্ব্বনাশের হাত হতে কারণ তা না হলে এদেশের নিঃস্ব ও নিঃসহায় কৃষককুল মরিয়া হয়ে পরিত্রাণ পেয়েছে মর্মান্তিক আক্রোশে রাশিয়া ও চীনের মত বিদ্রোহের রক্তধারায় বাংলা তথা ভারতের উচ্চ শ্রেণীকে নির্মূল করে ফেলত । কিন্তু অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুফল সম্বন্ধে নিশ্চয়তার সহিত কিছু বলা যায় না সাংগঠনিক প্রতিভার অভাব , প্রশাসনিক দুর্ব্বলতা ও জনসাধারণের উদাসীনতার ফলে এ শিক্ষা পূর্ব্বের চেয়ে বহুগণ বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও অনেকাংশে নিকৃষ্ট মানে নেমে গেছে । প্রাথমিক শিক্ষার অপূর্ণতার ফলে গত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে আমাদের মাধ্যমিক ও উত্তর শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নৈরাশ্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । বর্তমানের গ্র্যাজুয়েট আগেকার ম্যাট্রিক পাশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না । তাই জীবনের সর্ব্বক্ষেত্রে - শাসন , বিচার , শিক্ষা , স্বাস্থ্য ইত্যাদি দপ্তরের হিতাকাঙ্ক্ষী কর্তাদের ঐকান্তিক বাসনা সত্ত্বেও তাঁদের শুভ পরিকল্পনাসমূহ কার্যে পরিণত করা সম্ভব হচ্ছে না । আমি যখন চট্টগ্রামে কাজে যোগদান করি তখন এ জেলায় ছাত্রদের উপর সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষ নজর ছিল এবং সামান্য কারণ পেলেই তাদেরকে গরুপেটা করত । খেলাধূলার মাঠেও সরকারী কর্মচারীদের প্রাণ রক্ষার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হত । ১৯৩০ ইংরেজীর জানুয়ারী মাসে ক্রিকেট খেলার মাঠে দু'জন তরুণ বিপ্লবী নিহত হন , আর দু'জন আহত হন । ১৯৩১ এর ৩০ শে আগষ্ট রেলওয়ে ফুটবল কাপের শেষ খেলায় নেজাম পল্টনে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ সাহেবকে হরিপদ নামক এক যুবক গুলী করে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নেয় । আমি রংপুর থেকে শুনতে পাই চট্টগ্রামে এ উপলক্ষে কতকগুলি গুণ্ডা - প্রকৃতির লোক পুলিসের গোপন ইশারায় খাতুনগঞ্জ ও বক্সির হাট এলাকায় দোকান - পাট লুঠ করে । কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে উর্দ্ধতন জেলা কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে ওটা বন্ধ হয়ে যায় । অধিকন্তু সূর্য সেন কল্পনা দত্ত এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সন্ত্রাসবাদীরা তখনও ধরা পড়েনি । তাঁদের মধ্যে গোপনে যোগাযোগ রক্ষার এবং তাঁদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে তথায় নিয়ে যাবার ভার তরুণ ছাত্রদের উপরই ন্যস্ত ছিল । এ খবরে বিশ্বাস করে মধ্য - চট্টগ্রামের অর্থাৎ পটিয়া , বোয়ালখালী অঞ্চলের স্কুল ছাত্রদের উপর গোয়েন্দা বিভাগ কড়া নজর রাখত এবং সন্দেহ হলেই অমানুষিক শাস্তি দিত । আমি চট্টগ্রামে আসার পর নেত্র সেনের বিশ্বাসঘাতকতায় সূর্য সেন গৈরালা গ্রামে ধরা পড়েন । তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত কিছু দিন পরে গোয়েন্দার জালে আটকে পড়ে । বিচারে দুই বিদ্রোহীর হয় ফাঁসি এবং বিদ্রোহিনীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড । শহরের স্কুলগুলিতে বিদ্রোহীদের তৎপরতা ছিল কম । কাজেই পুলিশেরও জোর জুলুম ছিল না । শহরের ছাত্ররা অন্তরে যাই থাকুক কথাবার্তা ও চাল - চলনে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে নির্লিপ্ত দেখাত । মুসলিম হাই স্কুলে রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ এসে তখনও ভেঙ্গে পড়েনি । আমি একান্ত মনে এ স্কুলের সর্বাঙ্গীন উন্নতির বিষয় হেডমাষ্টার ও অন্যান্য শিক্ষকদের সহিত প্রায় আলোচনা করতাম । শিক্ষকেরা সকলেই আমার পূর্ব্ব পরিচিত বন্ধু - স্থানীয় লোক ছিলেন । আমার প্রস্তাবগুলি তাঁরা উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করতেন । হেডমাষ্টারও প্রথমে বেশ সায় দিতেন । তারপর ক্রমে তাঁর সন্দেহ হল যে , তাঁর প্রভাব থেকে স্কুলে আমার প্রভাব যেন দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে । এটা দেখে তিনি মাঝে মাঝে আমার কাজে বাধা দিতেন । স্কুলের অধিকাংশ ছেলে লুঙ্গি পরে এবং মাথায় টুপি না দিয়ে আসত । ড্রিল করবার সময় লুঙ্গি নিয়ে তারা মহা বিপদে পড়ত । ফুটবল খেলার সময় তাদের বিপদ ছিল আরও গুরুতর । চিৎপটাং হয়ে পড়লে তারা একেবারে নেংটা হয়ে যেত । এসব বিবেচনা করে স্কুলে নোটিশ দেয়া হল যেন সব ছেলে পায়জামা পরে আসে । পায়জামা পরলে আবার জুতা পরতে হয় । এ স্কুলে প্রায় গরীব মুসলিম ছেলেরাই পড়ত । কাজেই যাদের পায়জামা ও জুতা পরে আসার সঙ্গতি নেই তারা যেন ধুতি মালকোঁচা করে পরে আসে যাতে কেউ ছতরের দোহাই না পাড়তে পারে । তবে মাথায় যে কোন রকম টুপি পরে আসলে হবে । সপ্তাহের মধ্যে স্কুলে ছাত্রদের মাথার টুপি উঠল- যদিও তা পথে পকেটস্থ হয়ে থাকত । কিছুদিনের মধ্যে লুঙ্গিও প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল ! তখন পায়জামা বা মালকোঁচা ধুতিই কেবল চোখে পড়ত । কিন্তু কয়েক দিন পরে দেখলাম দশম শ্রেণীর ছেলেরা পুনরায় লুঙ্গি পরে আসছে । আমি মারমুখী হয়ে উঠাতে তারা বলল , “ স্যার , আপনি বলেন ধুতি পরতে আর হেডমাষ্টার বলেন লুঙ্গি পরতে । আমরা কার কথা শুনব ? " শুনে ক্রোধে যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম । কিন্তু মুখে কিছুই বললাম না । ঘণ্টার পরে হেডমাষ্টারের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করাতেই তখন স্বীকার করলেন । আমি তাঁর বললাম যে , আমার প্রস্তাব অনুসারেই তিনি আগের ব্যবস্থা করেছিলেন । কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি যে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সেটা আমাকে না জানানোর ফলে ছাত্রদের সামনে আমাকে অপ্রস্তুত হতে হয়েছে । এরূপ করা তাঁর পক্ষে ঠিক হয়নি । বোধ হয় হেডমাষ্টার বলেই তিনি এটা করেছেন । কিন্তু ভাল করেন নি । অল্পদিন পরে বটমলি সাহেব চট্টগ্রাম আসলে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার দ্বারা তাঁকে স্কুল থেকে বদলির জন্য অনুরোধ করালাম । তবে আমার সঙ্গে দেখা হলেও আমি নিজে কিছু বললাম না । মাস দু'য়েকের মধ্যে তাঁকে স্থানীয় নর্ম্যাল স্কুলে বদলি করে তাঁর স্থানে মরহুম আবদুস ছামাদ সাহেবকে নিযুক্ত করা হয় । ছামাদ সাহেব ট্রেনিং কলেজের লেকচারার ছিলেন । তিনি বি . টি . এবং বিলাতের লীড়ড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার ডিপ্লোমাধারী । ইতিপূর্ব্বে কিছুদিন সরকারী স্কুলে সহকারী শিক্ষকরূপে কাজ করেছিলেন । তিনিও আমার বি.এস.এস. এর গণ্ডী থেকে ছিটকে পড়ে মাষ্টারীতে আটকে গিয়েছিলেন । তবে তাঁরটা ছিল সাব - ডেপুটির গণ্ডী- এ যা প্রভেদ । সাব - ডেপুটি গণ্ডী থেকে খসে পড়া আরও দুজন লোক শিক্ষা বিভাগে কাজ করে উন্নতি করেছেন । তাঁদের একজন হলেন মরহুম মৌলবী জসীম উদ্দীন , যাঁকে আমরা বাংলার গেজেটিয়ার বলতাম । তিনি এ দেশের সমুদয় উচ্চ পর্য্যায়ের লোকদের নাড়ী - নক্ষত্রের খবর রাখতেন এবং তোতার মত অবলীলাক্রমে সেগুলি আওড়াতে পারতেন । আর একজন হলেন জুলফিকার সাহেব । সত্তরের কাছাকাছি বয়স , এখনও শিক্ষা বিভাগের কাজে নিযুক্ত আছেন । তিনি ধীর ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক , বেশ পড়াশুনা আছে ।



সামাদ সাহেব স্কুলে আসার পর আমি তাকে এর দারুণ শোচনীয় অবস্থার কথা বললাম এবং দু'জনে মিলে এটার উন্নতিকল্পে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করতে লাগলাম । ছাত্রদের পোষাক পরিচ্ছদের সংস্কার , পড়াশুনা ও খেলাধূলায় এবং কমনরুমের কার্যক্রম চিত্তাকর্ষক করার নানা উপায় উদ্ভাবন করে তা যথাযথ অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হল । আমরা ছেলে পিটাতে যেমন দু’জনেই ওস্তাদ তেমনি তাদের অভাব অভিযোগের প্রতিকারেও সমান তৎপর ছিলাম । পূৰ্ব্ববর্তী হেডমাষ্টার যাবার সময় সামাদ সাহেবকে এ বলে সাবধান করেছিলেন যে আমি সব বিষয়ে অত্যন্ত অনধিকার চর্চা করি এবং খুব অহঙ্কারী । কিছুদিন কাজ করার পর সামাদ সাহেব আমাকে এ কথা বললেন । তিনি আরও বললেন , আমরা দু'জনেই তো স্কুল পরিচালনায় নূতন । কাজেই খুব ভেবে চিন্তে কাজ করতে হবে । উত্তরে জানালাম , “ আমি নূতন নই । ” আমি ছয় বৎসর তিনটি বেসরকারী ভাল স্কুলে দক্ষতার সাথে হেডমাষ্টারী করেছি এবং তিনটি সরকারী স্কুলে সহকারী প্রধানশিক্ষক ছিলাম । সুতরাং স্কুল পরিচালনার ব্যাপারে আপনি নূতন হলেও আমি নূতন নই । কাজেই নৃতনের দুশ্চিন্তা অবাধে ত্যাগ করতে পারেন । এর পর দু’বছরের অধিক কাল তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি । কোনদিন আমাদের মধ্যে মতের গরমিল হয়নি এবং তিনি আমাকে বরাবরই আপন ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন । স্কুল দু'বৎসরের মধ্যেই ভাটির থেকে উজান - পথে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল এবং এ উজানের পথে আমিও মুসলিম হাইস্কুলে থাকাকালে অর্থাৎ ১৯৩৪ ইংরেজীর জুলাই মাসের শেষের দিকে শিক্ষামন্ত্রী স্যার আজিজুল হক , ডি.পি. আই বটমলি সাহেবসহ চট্টগ্রামে তিন দিনের সফরে আসেন । সে সময় তিন চারটি ফাংশানে স্যার আজিজুল হকের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে জানাশুনা হয় । মুসলিম এডুকেশান সোসাইটি তখন চট্টগ্রামের সর্বপ্রধান মুসলিম প্রতিষ্ঠান । মরহুম খান বাহাদুর জালাল উদ্দিন আহমদ সাহেব ( যিনি কিছুকাল অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী ছিলেন ) এ সমিতির সেক্রেটারী এবং আমি ছিলাম জয়েন্ট সেক্রেটারী । বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন পদাধিকার বলে বরাবরের জন্য প্রেসিডেন্ট । ' ডন ' খ্যাত এবং এককালীন কেন্দ্রীয় শিল্প - মন্ত্রী মরহুম আলতাফ হোসেন সাহেব তখন ইছলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপক ছিলেন । মুসলিম হলে থাক্‌তেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় এবং তার চট্টগ্রামে চাকরী পাবার ব্যাপারে আমারও কিছুটা হাত ছিল । তখন আমাদের মাথায় একদল কর্মী গঠনের কল্পনা কিলবিল করছিল । গুপ্ত সন্ত্রাসবাদীদের বিকল্প হিসেবে গ্রীন - শার্ট নামে একটি কর্মী সংস্থার সংগঠন বাস্তব রূপ লাভ করে । এর কেন্দ্রস্থল ছিল মুসলিম এডুকেশান সোসাইটির অফিস ও প্রাঙ্গণ । জামে মসজিদের উত্তর পার্শ্বের খোলা ময়দানে নানা স্কুল কলেজের তরুণ যুবকদের নিয়ে আমরা প্রথমে সবুজ ইউনিফরম পরিহিত চল্লিশ জন স্বেচ্ছাসেবককে শিক্ষাদান আরম্ভ করি । এ প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারী ছিলেন আলতাফ সাহেব আর আমি ছিলাম জয়েন্ট সেক্রেটারী । কাজ - কর্ম্মের ভার বেশীর ভাগ আমার উপর ছিল । মন্ত্রী সাহেবকে একদিন সকাল বেলা এ গ্রীন - শার্টের কুচকাওয়াজ ও ড্রিল দেখান হয় । সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় । দ্বিতীয়বার দেখা হয় স্কুল পরিদর্শনের সময় । তাঁর সঙ্গে ডি . পি . আই . ইন্সপেক্ট্রার , এস . ডি . ও . এবং আরও কে কে ছিলেন ঠিক মনে পড়ে না । তাঁর শুভাগমন উপলক্ষে ( চোঙ্গা ) উপহার দেয়া হয় । হেডমাষ্টার সাহেবের অনুরোধে আমি একটি সম্বন্ধনা কবিতা লিখি এবং তা রূপার কাস্‌কেটে এ কবিতাটি নাকি সকলের খুব ভাল লেগেছিল । বটমূলি সাহেব হেসে হেসে জিজ্ঞেস করলেন , “ তুমি কবিও নাকি ? ” আমি বললাম , হ্যাঁ স্যার , হবার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু হতে পারলাম না । " মন্ত্রী সাহেবও এ দু'দর্শনে আমার সম্বন্ধে ভাল ধারণা করেছেন , বুঝা গেল । কিন্তু হায়রে নসীব । তারপর সেদিন সন্ধ্যায় যা ঘটল তাতে আমার সম্বন্ধে তাঁর সব ধারণা উল্টে ত গেলই , উপরন্তু তাঁর মন আমার বিরুদ্ধে অত্যন্ত বিষিয়ে উঠল । কারণটা একটু বুঝিয়ে বলতে হয় । আমাদের এক বৎসরের সিনিয়ার , মুসলিম হলের সহচর জনাব মিজানুর রহমান তখন চট্টগ্রাম বিভাগের কো - অপারেটিভ এ্যাসিষ্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার ছিলেন । তিনি জে . এম . সেনের বড় বাড়ীতে থাকতেন । বিগত দু’বৎসর থেকে তিনি হাজী মুহসিন সম্বন্ধে বিশেষ বাড়াবাড়ি করছিলেন । মুহসিন দিবস উপলক্ষে তিনি বার্ষিক সভায় বেশ আড়ম্বর সহকারে ছাত্র - ছাত্রী ও অন্যান্য শিক্ষিত লোকের লিখিত হাজী মুহসিনের জীবনী সম্বন্ধে রচনা প্রতিযোগিতা ও বক্তৃতার আয়োজন করতেন । আমাকে অবশ্য সংগঠনী কমিটিতে রাখতেন । তবে ইহাতে আমি বিশেষ কিছু গুরুত্ব আরোপ করতাম না । তখন বিভাগীয় ইনস্পেক্টার ছিলেন খান বাহাদুর কর্ণেল আবু জাফর সাহেব । তাঁর বিরাট আকৃতি ও গম্ভীর প্রকৃতি দেখে অধীনস্থ লোকদের হৃদকম্প উপস্থিত হত । তিনি ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত । কাজেই তাঁর আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতায় মিজানুর রহমান সাহেব এ অনুষ্ঠান দিবস প্রতিপালনের সুবিধা পেতেন । সে বছর তিনি মুহসিন স্মৃতি - বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মন্ত্রী সাহেবের সভাপতিত্ব করার ব্যবস্থা করলেন । তদুপরি তিনি ' মুহসিন ডে ’ কে শিক্ষা বিভাগের ছুটির দিন হিসাবে গণ্য করার জন্য প্রস্তাব পাশ করার বন্দোবস্তও করলেন । তিনি হাজী মুহসিনকে শিক্ষার উন্নতির জন্য পৃথিবীর সর্বপ্রথম সর্ব্বস্ব দানকারী হিসেবে আখ্যায়িত করতে গৌরববোধ করতেন । এ বাড়াবাড়ি আমার ভাল লাগত না । তাঁকে অনুরোধ জানাই যেন বার্ষিক সভায় আমাকেও বক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় । আমি হেসে বললাম , সভায় একটি বোমা পড়ার আশঙ্কা আছে । তিনি উত্তরে শুধু বললেন , “ মন্ত্রী সাহেব থাকবেন , দেখ , কোন পাগলামি কর না । " আমি বসে বসে স্যার আজিজুল হকের শিক্ষার প্রসার সম্বন্ধে লিখিত পুস্তকে ও বাংলার এডুকেশন কোড - এ হাজী মুহসিনের উইল ও তৎসম্বন্ধে পরবর্তীকালে যা ঘটেছিল তা পড়ে ইংরেজীতে নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখলাম এবং ঐ সভায় উহা পড়ব বলে স্থির করলাম । প্রথমে সামাদ সাহেবকে দেখালাম । অন্য কাউকে ঘুর্নাক্ষরেও জানতে দিলাম না । সামাদ সাহেব খুশীতে ফেটে পড়লেন । আর বললেন , " বেশ মজা হবে , বেটার বাহাদুরী বের হবে । " আমার মনে যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল হয়ত সভায় এ নিয়ে একটা গণ্ডগোলও হতে পারে । সুতরাং ঠিক হল , সমর্থনের জন্যে স্কুলের ছাত্র ও অন্যান্য পরিচিত লোকদের নিয়ে যেন তিনি তৈরী থাকেন । শীতের সন্ধ্যায় যেন জ্বর জ্বর লাগছিল । আমি কাপড় পরেও যাব কি যাবনা- এ নিয়ে অনেক অনেকক্ষণ ইতস্তত স্বরে শেষ পর্যন্ত সভায় গিয়ে উপস্থিত হলাম । দেখলাম কৰ্ম্মসূচীতে বক্তাদের চার নম্বরে আমার নাম দেয়া হয়েছে । মুসলিম হল ও তৎসংলগ্ন প্রাঙ্গণ একেবারে লোকে লোকারণ্য । স্মরণ থাকতে পারে যেখানে বর্তমানে জেমিসন মেটার্নিটি হাসপাতাল সেখানেই পূর্ব্বের মুসলিম হল ছিল । হল - ঘরের বারান্দায় বসেছিলেন প্রেসিডেন্ট , দক্ষিণ - মুখী হয়ে । আর তাঁর দু'দিকে প্রশস্ত বারান্দায় ও সামনের প্রাঙ্গণে চট্টগ্রামের উচ্চ পদস্থ ও শিক্ষিত প্রায় সমুদয় হিন্দু মুসলমানই উপস্থিত ছিলেন । কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপকবৃন্দ ও স্কুলের শিক্ষকেরা ত ছিলেনই , আর বাদ বাকী যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেকেই স্কুল কলেজের ছাত্র । মিজানুর রহমান সাহেব সেক্রেটারী হিসেবে তাঁর কার্য্য বিবরণী পড়ে হাজী মুহসীন সম্বন্ধে অনেক বড় বড় কথা বললেন । শিক্ষার জন্যে দান করার ব্যাপারে তাঁর মহত্ব ও দূরদৃষ্টির ভূয়সী প্রশংসা করলেন । তারপরের বক্তাও তাঁকে অনুসরণ করে কিছু বলার পর বাগ্মী প্রবর অধ্যাপক পঞ্চানন ভট্টাচার্য্য ওজস্বিনী ভাষায় মিজানুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাজী মুহসিনের বদান্যতা ও নানা গুণের প্রশংসায় সভা সরগরম করে তুললেন । মুহুর্মুহু করতালি ও হর্ষধ্বনিতে বক্তৃতা তাঁর অভিনন্দিত হচ্ছিল । তিনি বসে পড়লে আসল আমার পালা । আমি মনে মনে একটু সঙ্কোচ ও দ্বিধা নিয়ে পকেট থেকে কাগজ বের করে পড়তে আরম্ভ করলাম । আমার মূল বক্তব্য ছিল " Hero worship must not be built on false premises . Mohsin was great enough without our failsely magnifying his qualifies . " অর্থাৎ কিনা বীর ও মহৎ ব্যক্তিদের গুণগ্রামের প্রশংসা ভিত্তিহীন জনরবের উপর রচিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় । মুহসিন সাহেবের চরিত্র এমনিতেই এত মহৎ ছিল যে , তাঁর গুণগ্রাম অকারণে বাড়িয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না । তারপর বললাম মুহসিন সম্বন্ধে স্কুল ও কলেজ ছাত্রদের রচনাগুলি পরীক্ষা করে দেখার সময় আমি একটি বিষয়ে সকলের একমত দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলাম । অথচ এ বিষয়টি একেবারেই মিথ্যা । কারণ তাঁরা সকলেই লিখেছেন যে , হাজী সাহেব তাঁর সব সম্পত্তি শিক্ষা প্রসারকল্পে উইল বা ওয়াক্ফ করে গেছেন এবং তজ্জন্য তিনি সমগ্র শিক্ষিত জগতের শ্রদ্ধার পাত্র । তাদের মধ্যে কি করে এ ভুল ধারণার সৃষ্টি হল তা জানি না । বোধ হয় অনেক ভিত্তিহীন কিংবদন্তীর মত এটাও লোকের মুখে মুখে বহুল প্রচার লাভ করেছে । সেজন্য আমি মনে করি প্রকৃত অবস্থাটা ছাত্রদের জানিয়ে দেয়া উচিৎ । বাস্তবিক হাজী সাহেবের এই উইল তখনকার দিনের হাজারো অন্যান্য উইলের মতই ছিল । এটার কোন বিশেষত্ব ছিলনা । একমাত্র বিশেষত্ব যেটা প্রথমেই নজরে পড়ে সেটা হল তাঁর দু'বন্ধুকে মোতওয়াল্লী নিযুক্ত করে তাঁদের জন্য মোট লাভের নয় ভাগের দু’ভাগ অর্থাৎ প্রায় একচতুর্থাংশ দিয়ে দেয়া । তিনি তিন ভাগ শুধু হুগলীর ইমামবাড়া ও তৎসংলগ্ন মক্তবের এবং বার্ষিক ফাতেহা ও শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যয় বাবদ নির্দিষ্ট করে যান । তার চার ভাগ আত্মীয় - স্বজন ও গরীবদের ভরণ - পোষনের জন্য নির্ধারিত করে দেন । কিন্তু মুসলিম সমাজের সৌভাগ্যক্রমে তাঁর দু'বন্ধুর পারস্পরিক ভাগ - বাটোয়ারা নিয়ে বিবাদ ও অন্যান্য দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপের ফলে সরকার এ ওয়াক্ফ সম্পত্তির পরিচালনার ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে মোতওয়াল্লীদের বিরুদ্ধে সরকার যে মামলা রজ্জু করেন বার বৎসর পরে তার রায় মোতাবেক দু’মোতওয়াল্লীকে বরখাস্ত করা হয় । কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁদের অংশের টাকা সরকারী তহবিলে জমা হয়ে সুদসহ প্রায় বার লক্ষে দাঁড়ায় । তদুপরি ফি - বছর শেষোক্ত চার ভাগের অনেকটাও সঞ্চিত হতে থাকে । এটা কি উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যায় তা স্থির করবার জন্য লর্ড বেন্টিঙ্ক ও তাঁর উপদেষ্টাগণের এক বৈঠক বসে । উক্ত বৈঠকে স্থির হয় যে , এ টাকা মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতিকল্পে ব্যয় করা উচিৎ । তদনুসারে মুহসিন “ এডুকেশান ফাগু " গঠিত হয় এবং বছর বছর জমিদারীর আয় থেকে উইলের বিভিন্ন খাতে উদ্বৃত্ত টাকা এতে জমা হতে থাকে । এ ফাণ্ড থেকে গরীব মুসলমান ছাত্রদের ইংরেজী ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হত । কিন্তু এ ব্যয়ের ব্যাপারে শিয়া - সুন্নির কোন তারতম্য করা হত না । সেকালের এবং একালের সমুদয় ওয়াক্ফ সম্পত্তি কোন এক মসজিদ বা মাদ্রাসাকে উপলক্ষ করে আল্লার নামে উৎসর্গ করা হয় । সুতরাং হাজী সাহেবের উইলের বৈশিষ্ট্য কোথায় এবং বিশেষ প্রশংসা লাভের অবকাশও বা কৈ ? যদি এ প্রশংসা কারও প্রাপ্য হয় তবে তা হবে সরকারের । এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই রোষে , ক্ষোভে ও অপমানে সভার উদ্যোগকারীরা , বিশেষ করে সেক্রেটারী মিজানুর রহমান সাহেব এবং সভাপতি ইনস্পেক্টার আবু জাফর সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবং সভার চার দিক থেকে শ্রোতৃবৃন্দ - এ ক্ষিপ্ততায় যোগ দিলেন । তাঁরা আমাকে আর কিছু পড়তে না দেয়ার দাবী জানালেন । আগেই বলেছি সামাদ সাহেব দলবল নিয়ে পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন । তাঁরা বললেন , তিনি কি বলতে চান- শুব ? খান বাহাদুর আবদুস ছত্তার সাহেবও সভার মধ্যস্থল থেকে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন , প্রত্যেকেরই বলবার স্বাধীনতা আছে । বক্তা আরও কি বলতে চান আমরা শুনতে চাই । হিন্দু দর্শকেরা অর্থাৎ প্রফেসার , শিক্ষক , চাকুরিয়া ও আইনজীবীরা দু’পক্ষের এ কোন্দল দেখে মনে মনে খুশী হয়ে চুপ করে রইলেন । কোন পক্ষই নিলেন না । গোলমাল বাড়ছে দেখে সভাপতি মন্ত্রী সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন , আমি এ বক্তার সমুচিত জবাব দেব । আপনারা তাঁকে বলতে দিন । এ অবস্থায় আমার স্নায়ুমণ্ডলীর উপর যথেষ্ট চাপ পড়েছিল । আমি নার্ভাস হয়ে পড়লাম এবং গলার জোর কমে গেল । আমার বক্তব্যও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল । আমি বলেছিলাম , মনুজানের কোন সন্তান না থাকায় অতি বৃদ্ধ অবস্থায় এই একান্ত ধার্মিক ও স্ত্রী - পুত্রহীন মুহসিনের হাতে তাঁর সম্পত্তি এসে পড়া , দু’বিশ্বস্ত বন্ধুকে মোতওয়াল্লী নিযুক্ত করা , পরিশেষে এ দু’বন্ধুর পরস্পরের রেষারেষি ও ষড়যন্ত্রের ফলে পদচ্যুত হওয়া এবং সর্ব্বশেষে সরকারের হাতে তাদের অংশের টাকা জমা হওয়া এ সবই করুণাময় আল্লার ইচ্ছায় মুসলমানের উন্নতি - কল্পে ঘটেছিল । ভাগ্যবতী মন্নুজান ও মহামতি হাজী মুহসিনের ওয়ারিশ অভাবে তাঁদের ত্যজ্য - বিত্ত সমগ্র জাতির কল্যাণকল্পে ব্যয়িত হওয়ার সমস্ত পুণ্য তাঁদেরই প্রাপ্য । তাঁদের পুত্র - কন্যা না থাকা এবং বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতা জাতির পক্ষে মহামঙ্গলের কারণ হয়েছিল । হাজী মোহাম্মদ মুহসিন ইচ্ছা করলে সম্পত্তি ওয়াক্ফ না করে কাউকেও দান করে যেতে পারতেন । তাহলে কারও কিছু বলার থাকত না । কিন্তু তিনি তা না করে , যা করে গিয়েছিলেন তজ্জন্য সমগ্র জাতিই তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতা পাশে চিরদিন আবদ্ধ থাকবে । পরবর্ত্তী বক্তা হাবিবুল্লা বাহার ( যিনি মন্ত্রী থাকাকালীন ঢাকার মশা নির্বংশ করেন ) এবং আরও জনকয়েকের সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর সভাপতি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন । উত্তেজিত হল তাঁর বাগ্মিতা ও ডায়াগড়ি উল্টাসের হয়ে উঠত । তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন , কারণ অনোয়ানা জানলেও তিনি জানতেন যে , আমি যা বলেছি তা প্রকৃত সত্য । কিন্তু এ মিশ্র সভা মুহসিনের স্মৃতির প্রতি যে মহৎ কাজের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করার উদ্দেশ্য এত আড়ম্বর সহকারে আহত হয়েছে সেখানে হাট হাঁড়ি ভাঙার মত কোন মুসলমান যে এমন বেফাঁস কথা বলতে পারে , এটা তিনি ধারণাই করতে পারেন নি । সুতরাং প্রথমে আধুনিক যুবকদের প্রাচীন যা কিছু সব ভেঙে চুরে তছনছ করে দেয়ার একটা জঘণ্য মনোবৃত্তি যে যেখানে সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার নিন্দা করে বললেন , “ এ মানসিকতা কিছুতেই নির্বিচারে সমর্থন করা যায় না । সুতরাং তিনি আমার উক্ত বক্তৃতার জন্য অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করে উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করলেন , " In this case I would rather range myself with the false Historians than with the true and should say that Haji Md . Mohsin's contribution for advancement of education among the Muslims of the country can not be denied . " অর্থাৎ কিনা হাজী মোহাম্মদ মুহসিনের দান সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্যে প্রতিষ্ঠিত না হলেও তিনি প্রচলিত ধারণারই পক্ষপাতী এবং মুহসিনের দানে মুসলিম শিক্ষার ক্ষেত্রে যে উন্নতি ঘটেছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই । এ পর্যন্ত শুনে মনে আমি কিছুটা শান্তি ও বল পেলাম এবং সকলের অলক্ষ্যে আমার এক সঙ্গীকে নিয়ে সভাস্থল থেকে পেছন দিকে বের হয়ে ঘোড়ার গাড়ী করে বাসায় চলে এলাম । তার পরদিন আমার বিশিষ্ট বন্ধু সদর - দক্ষিণ চট্টগ্রামের এস.ডি. ও . অতি জনপ্রিয় নোমানী সাহেব আমার বাসায় এসে অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে জানালেন যে চট্টগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের এক ভোজসভায় ( যেখানে আমারও নিমন্ত্রণ ছিল ) মন্ত্রী সাহেবের নিকট কয়েক ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে সমালোচনা করছিলেন । তাতে নাকি মন্ত্রী সাহেব বলছিলেন ‘ ‘ আমি তাঁর কাজকর্ম দেখে পদোন্নতির কথা চিন্তা করছিলাম । কিন্তু শেষ অঙ্কে সে সব ভেস্তে দিল । নোমানী সাহেব সেখানে আমাকে সমর্থন করে অনেক কিছু বলেছিলেন । যথা- সে একজন জানান্বেষী সত্য - সাধক । সে অনুসন্ধানে যা পেয়েছে সরল বিশ্বাসে তাই লিখে দিয়েছে । এ নিয়ে যে এত হৈ চৈ হবে সে তা ভাবেনি । এর উত্তরে বলা হয়েছিল , " যার এটুকু দূরদৃষ্টি নেই এবং যে অবলীলাক্রমে সকলের সামনে আমাদের মাথা হেঁট করে দিতে পারে , তার বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে সন্দেহ আছে । " এর পরে ষ্টেশনে আমি তাঁকে বিদায় দিতে যাইনি । সামাদ সাহেব তাঁর চিরসাথী মোটা লাঠি হাতে উপস্থিত ছিলেন । তাঁকে দেখে মিজানুর রহমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন , “ ঐ পাগল বোঝাটা কোথায় ? " তিনি এমনিতে তার উপর চটা ছিলেন । তদুপরি এ কথা শুনে একেবারে রেগে আগুন হয়ে উঠলেন । উত্তর দিলেন , “ তোমাদের চোখে যার জ্ঞান আছে , সে মূর্খ । আর যার সত্য - ভাষণের সৎ সাহস আছে সে ত পাগলই বটে । " এর পরে দু'জনে মারামারি হবার উপক্রম । হেডমাষ্টার সাহেব দীর্ঘদেহী ও লশুড় - হস্ত ছিলেন বলে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রকায় , “ বিন্ হাতিয়ার " মীজানুর রহমান সাহেবকে সরে পড়তে হল । কয়েক দিন আমার খুব মনমরা অবস্থায় কাটল । বিশেষ করে ১৯৩৫ সালে আমার হেডমাষ্টার হওয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হল ভেবে আমি মনে মনে ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠলাম । স্থির করলাম ঐ সালে যদি আমার পদোন্নতি না হয় কোন এক ভাল প্রাইভেট স্কুলে হেডমাষ্টার হয়ে চলে যাব এবং সমাজ সেবা ও রাজনীতি চর্চ্চায় মনোযোগ দিয়ে অবশেষে চাকরী ছেড়ে পাবলিক লাইফে ঝাঁপিয়ে পড়ব । কিন্তু ভবিতব্য রোধ করে কে ? ১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাস । হেডমাষ্টারীর জন্য লোক বাছাই ছিল । কমিটি যাঁকে মনোনীত করতেন তাঁকেই নিযুক্ত করা হত । প্রথমেই সিলেকশন কমিটির সামনে আমার ডাক পড়ল । কিন্তু ঘরে ঢুকেই আবহাওয়াটা কেমন নিরুৎসাহজনক মনে হল । কমিশনার সাহেব গম্ভীর মুখে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছিলেন । তিনি প্রথমেই প্রশ্ন করে বসলেন , " বিজ্ঞাপনে এম . এ . এম.এস.সি ফার্স্ট ক্লাস চাওয়া হয়েছিল । তুমি ত সেকেও ক্লাস । তুমি এখানে আসলে কি করে ? " উত্তরে সবিনয়ে “ আমি দরখাস্তে কিছুই ত গোপন করিনি । তবুও আমাকে কেন ডাকা হয়েছে সেটা ত আমার জানার কথা নয় । ” এ সময় আমার পূর্ব পরিচিত বোর্ডের সেক্রেটারী ব্যানার্জী সাহেব বললেন যে আমি ইংরেজীতে সেকেণ্ড ক্লাস , আর ফার্স্ট ক্লাস যাঁরা আছেন , তাঁরা হয় কোন ক্লাসিক্যাল বিষয় অথবা দর্শন , ইতিহাস , অঙ্কের এম . এ . । এ কথা শুনে কমিশনার সাহেব আর কিছু বললেন না । শুধু মাথা নাড়লেন । এর পরে আর কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করে বিদায় দিলেন । বুঝলাম আমার নিরুৎসাহ হওয়ার কোন কারণ নেই । আশা নিয়ে আমি কলকাতা থেকে বাড়ী ফিরলাম । সে বছর ডিসেম্বর মাসে রোজা পড়েছিল । গ্রীষ্ম - বন্ধ ও রোজার মৌলভী রেখে কয়েকজনে বন্ধে আমি সপরিবার বাড়ীতে থাকতাম । সে বন্ধে বাড়ীতে জানালাম , মিলে তারাবির নামাজ পড়তাম । আর প্রায় সারাদিন কোরআন শরীফ নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম এবং তার মধ্যে যে বাণী সুন্দর ও পরকাল বা ইহকাল সম্বন্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হত সেটি একটি ছোট খাতায় নোট করে রাখতাম । এ নোট বইটি ছিন্নভিন্ন অবস্থায় এখনও আমার কাছে আছে । ১৯৩৩ ইংরেজীতে মুসলিম হাই স্কুলে বদলী হওয়ার পর থেকে ১৯৪৯ ইংরেজী পর্যন্ত কোরআন মজিদের ইংরেজী - বাংলা - তফসীরসহ রোজার বন্ধে পড়তাম ও নোট করতাম । ছোট বেলা থেকেই মৌলভী - ঘেঁসা বলে আমার বদনাম ছিল । তার উপরে ছিল কূটতার্কিক বলে বন্ধু - মহলে অখ্যাতি । সারা বৎসর কোরআন মজিদের বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক অংশসমূহ যেমন আমি মুখস্থ করতাম সেরূপ এ সুদীর্ঘ কিতাবের শ্লোকাদির মধ্যে কোন পরস্পর বিরোধী ভাবের বা অর্থের মধ্যে সামঞ্জস্য আবিষ্কারের চেষ্টায় উপযুক্ত লোকের সঙ্গে আলোচনা ও পুস্তক পাঠ ছাড়াও নিজে অনেকদিন ধরে ভাবতাম । এরূপ মনোযোগের সহিত কোরআন মজিদ অধ্যয়নের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল । সে উদ্দেশ্যটা একদিন হঠাৎ কথায় কথায় সামাদ সাহেবের সামনে বলে ফেলি । এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীকে তিনি দুঃখ করে বলছিলেন , “ উহ্ ! অবসর নেয়ার কথা আমি ভাবতেই পারিনে । মনে হয় যেন অবসর নেয়া অর্থ মরে যাওয়া । অবাক বিস্ময়ে আমি বল্লাম “ অবসর নেয়ার সময় অবশ্য আমার হয়ে উঠবে না । আমার যে শরীর তাতে পঞ্চারের বহু পূর্ব্বেই এর সমাধি হবে । কিন্তু যদি বেঁচে থাকি তবে আমি ইসলামের যতটুকু বুঝেছি ততটুকু তবলিগ করে বেড়াব । " এ কারণে আমি সকাল বেলায় এক ঘণ্টা এবং বন্ধের দিন প্রায় অর্ধেক সময় কোরআন শরীফ ও অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তক পাঠে কাটাতাম । ইসলাম সম্বন্ধে অমুসলমানের লেখা ইংরেজী আসল এবং অনুবাদ যত বই পেতাম সেগুলি মনোযোগের সহিত পড়ে নোট করতাম । মুসলিম হাই স্কুলে পনর বৎসরের অধিককাল চাকরী করার ফলে রোজার বন্ধের পনরটি মাস একান্তভাবে আমি ধর্মজ্ঞান আহরণে নিয়োগ করতে পেরেছিলাম । এটাও একটি আল্লাহ প্রদত্ত সুযোগ । ১৯৩৪ সাল হতে মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তির জন্য ভিড় জমতে শুরু করে । এর মধ্যে পরীক্ষা করে প্রথমে গরীব মেধাবী ছাত্রদের নেয়া হত । তারপর মেধাবী অবস্থাপন্ন ছেলেদের নিয়ে খেলাধূলায় নামকরা ছেলেদের জন্য দু তিনটি করে আসন সকল শ্রেণীতে রিজার্ভ রাখা হত । এরপর অবস্থাপন্ন অথচ তেমন ভাল নয় এমন ছাত্রদের মধ্যেও যারা স্কুলের পুওর ফাণ্ডে বা অন্য কোন প্রকার হিতকর স্কীমের জন্য দান করতে ইচ্ছুক এমন কয়েকটি আসন তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকত । এরূপে অনেক গরীব ছাত্রদের পুওর ফাণ্ড থেকে সাহায্য করা সম্ভব হত । কারও নিকট হতে টাইপ রাইটার মেসিন , কারও কাছ থেকে সেলাইয়ের কল যোগাড় করে গরীব এবং শিখতে ইচ্ছুক ছাত্রদের স্কুল ছুটির পরে শিখাবার বন্দোবস্ত করে দেয়া হল । থান হিসেবে অতি কম মুনাফায় বড় ব্যবসায়ীদের নিকট হতে কাপড় ক্রয় করে সে কাপড় দ্বারা স্কুলে দর্জ্জি রেখে অতি কম মূল্যে পাঞ্জাবী পায়জামা বিক্রী করা হত । যারা খুব গরীব তাদের বিনামূল্যেও দেয়া হত । স্কুলের অর্ধেক ছাত্রকেও আমাদের সরবরাহ করবার দরকার হল না । কারণ আমাদের এরূপ অগ্রহাতিশয্যে অন্যান্য ছেলেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ধুতি - লুঙ্গি পরা ছেড়ে দিল এবং মাথায় সাদা টুপি উঠল । স্কুল কম্পাউণ্ডে বিড়ি সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ করা হল । রাস্তাঘাটে কোন ছাত্রের মুখে বিড়ি সিগারেট দেখলে সেজন্য তাকে বিশেষ শাস্তি দেয়া হত । কথাবার্তায় চাল - চালনে , কাপড় - চোপড়ে এ স্কুলের ছাত্রদের একটি বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা ক্রমশঃ লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল এবং এর সাথে বছরের পর বছর পরীক্ষার ফল ভাল হওয়াতে স্কুলের জনপ্রিয়তাও ক্রমে বৃদ্ধি পেল । খেলাধূলায়ও আমাদের সমান দৃষ্টি ছিল । বলাবাহুল্য আমাদের এ সমস্ত কাজে সহকারী শিক্ষকদের ছিল পূর্ণ ও আন্তরিক সহযোগিতা । বন্ধের দিনেও আমরা অনেক সময় বিনা পয়সায় ক্লাশ নিয়েছি । এ জোয়ারের মুখে আমি খুলনা জিলা স্কুলে হেডমাষ্টার হয়ে চলে গেলাম । আমি খুলনা যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে গ্রীষ্ম - বন্ধে এক দুপুরে স্বপ্ন দেখলাম যে , আমি সামাদ সাহেব থেকে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের চার্জ বুঝে নিচ্ছি । এ দূর পরবাসে মন আমার নানা কারণে বাড়ীর কাছে কোথাও বদলীর জন্য স্বাভাবিকভাবেই উদ্গ্রীব ছিল । এ স্বপ্ন দেখে আমার বিশ্বাস হল যে , আমি হয়ত চট্টগ্রামেই আবার ফিরে যাব । কিন্তু তা কি করে সম্ভব হতে পারে , বুঝতে পারলাম না । তবে আমার আগেকার কয়েকটি স্বপ্ন শীঘ্র হোক বা বিলম্বে হোক সফল হওয়াতে যে কোন জাজ্বল্যমান স্বপ্নের সত্যতা সম্বন্ধে আমার মনে একটা বিশ্বাস জন্মেছিল । খুলনা স্কুলে থাকাকালীন প্রথম দিকে যে সব অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্পেক্টার সাহেব আমাকে ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিভাগে বদলীর জন্য ডি , পি , আই এর নিকট প্রস্তাব করেন এবং তিনিও উহা সমর্থন করে শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারী মি : গ্রাহামের অনুমোদনের জন্য পাঠান । ইন্সপেক্টার সাহেবের চিঠিতে বদলীর ব্যাপারকে জোরালো করবার জন্য লিখা ছিল যে , আমি নিজে গুঞ্জদের ভয়ে বদলী হতে চাইনি । তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত । কিন্তু তিনি নিজে পাবলিক ইন্টারেষ্ট বা জনস্বার্থে আমার বদলীর প্রস্তাব করেছেন । গ্রাহাম সাহেব এ কয়েক ছত্র পড়ে ফাইলে লিখলেন “ He is a brave boy . Let him fight and give him all help and taransfer him whenever he seeks it " কাজেই আমার বদলী স্থগিত রইল । এর ছয় মাস পরে খান বাহাদুর ফখরুদ্দিন আহমদ সাহেব যখন সহকারী ডিরেক্টর ছিলেন তখন আমি কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে অফিসে দেখা করে অনুরোধ করলাম যে , মেহেরবানী করে আমার বদলীর কেসটা তিনি যেন একটু বিবেচনা করেন এবং এটা যত শীঘ্রই হয় তত মঙ্গল । আমার ভয় ছিল তিনি আমাকে পাত্তা দিবেন না । কারণ মুসলিম হলে তিনি হাউস টিউটর থাকার সময় একবার আমরা কয়েকজন মিলে কোন এক ব্যপারে রাত এগারটার সময় তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁকে নানারূপ গালাগালি করে ও তার শোবার ঘরে ইটের টুকরা ছুঁড়ে নানা প্রকার হইহল্লা করে ফিরে এসেছিলাম । তিনি জানতেন সিলেটের মোনেম চৌধুরী ও আমি সেই নৈশ অভিযানের পুরোভাগে ছিলাম । কিন্তু তিনি অতি সহয়তার সহিত আমাকে গ্রহণ করলেন এবং আমার অসুবিধার কথা শুনে একমাসের মধ্যেই আমাকে চট্টগ্রামের নিকটস্থ কোন স্কুলে বদলী করার আশ্বাস দিলেন । তিনি অত্যন্ত রাশভারী ও কর্মদক্ষ অফিসার ছিলেন । কাজেই তাঁর কথায় বিশ্বাস করে ফিরে আসলাম । এক মাস যেতে না যেতেই চিঠি পেলাম আমাকে ঢাকা মুসলিম হাই স্কুলে বদলী করা হয়েছে । এতে খুব খুশী হলাম । গোলাম রহমান সাহেবের কাছে তৎক্ষণাৎ চিঠি দিলাম । তিনি ছিলেন সেখানে ইনকামট্যাক্স অফিসার । তাঁর বাসার নিকট আরমানিটোলা মাঠের উত্তর পার্শ্বে বাসা ঠিক করে তিনি চার দিনের মধ্যেই তিনি আমাকে চিঠি লিখলেন যে , ঘর ঠিক হয়েছে । আমার বাঁধাছাদা সব হয়ে গেছে । কয়েকদিন ধরে বিদায় ভোজে ও বিদায় সম্বর্ধনায় প্রশংসা শুনে শুনে বেড়াচ্ছিলাম । হঠাৎ যাত্রার পূর্ব্ব রাত্রে টেলিগ্রাম পেলাম যে , আগের আদেশ নাকচ করে আমাকে চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলে দেয়া হয়েছে । কি যে আনন্দ হল আর কি করে আল্লার শোকরিয়া আদায় করব তা ভেবে পেলাম না । মনে পড়ল খুলনা যাওয়ার তিন মাস পরে সামাদ সাহেবের নিকট হতে মুসলিম হাই স্কুলের চার্জ নেবার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হল । আমার অতি সাধের পুরানো কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসলাম । কিন্তু তবুও মনের মধ্যে অতি সঙ্গোপনে যে বেদনার সুর বেজেছিল , সাউথপোল থেকে নর্থপোলে যাবার যে সূক্ষ্ম অনুভূতি আমার আনন্দবোধকে খর্ব করেছিল তা কাকেও বলতে না পারলেও আমাকে ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনস্ক করে তুলত । আমার সময় থুলনা স্কুল - টীম ফুটবল খেলায় খুব নাম করেছিল । এ টীমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অতি ঘনিষ্ঠ । তারা বীরেশ বাবুকে ধরে বরিশাল জিলা স্কুলের সঙ্গে আমার যাবার সময় এক ফুটবল খেলার বন্দোবস্ত করেছিল । আমি জাহাজে এসে দেখি প্রায় চল্লিশ জনের কাছাকাছি “ খেলোয়াড় ও অ - খেলোয়াড় ” প্রিয় ছাত্র ও তিনজন প্রিয় শিক্ষক একই ষ্টিমারে উঠে পড়েছেন । আমি সব দেখে শুনে তাঁদের আদর ভালবাসায় একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম । বরিশালে এসে আমি স্বপরিবারে জিলা ইনসপেক্টার মৌলবী মুখলেচুর রহমান সাহেবের বাসায় উঠলাম । মুন্সেফ মোজাফফর সাহেবও আমাকে নিতে এসেছিলেন । স্থির হল রাত্রে তাঁর ওখানে খাবার পর চাঁদপুরগামী ষ্টিমারে উঠব । ছেলেরা মাষ্টারদের সহ জিলা স্কুলের হোটেলে গিয়ে উঠল । কয়েকদিন ধরে অনবরত বৃষ্টি হওয়ার ফলে বরিশালে রাস্তাঘাট ও খেলার মাঠ জলে কাদায় একাকার হয়ে গিয়েছিল । সকালে হেডমাষ্টার খান সাহেব সিরাজউদ্দিন আহমদের বাসায় গেলাম । তিনি আমার অল্প কিছুদিন পূর্ব্বে খুলনা জিলা স্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন । সৌম্য , শান্ত , অতি অমায়িক প্রকৃতির ধার্মিক মুসলমান । তিনি সকল সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন । তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রামে আমার চাক্ষুষ পরিচয় থাকলেও অন্তরঙ্গতা ছিল না । তিনি আমাকে অতি হৃদ্যতার সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং বিকেলে খুলনার মাষ্টার ও ছাত্রদের সহ চায়ের দাওয়াৎ করলেন । খেলায় দু’গোলে বরিশাল স্কুল হারলেও জল খাবারটা খুলনার ছেলেরা বেশ ভালই পেল । সেখানে সেই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকের সাথে পরিচয় হল । তাঁদের মধ্যে কাজী মোহাম্মদ সিরাজুল হকও ছিলেন । তিনি এক বৎসরের মধ্যে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে বদলি হয়ে আসেন এবং যুদ্ধের সময়টা এখানে কাটিয়ে উত্তরবঙ্গ ও সিলেট ঘুরে এ স্কুলে আমার চেষ্টায় হেড মাষ্টার হয়ে আসেন এবং বেশ সুখ্যাতির সঙ্গে চাকুরী করে অবসর নেন । ১৫৯ রাত্রে ষ্টিমারে উঠে ডেকে গিয়ে দাঁড়ালাম । প্রায় চল্লিশ জন খুলনার ছেলে সারি করে দাঁড়িয়ে এক একজন করে জাহাজ - ভরা লোকের সামনে যখন আমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম ও প্রণাম করে বিদায় নিচ্ছিল , তখন আমার মনে হল এ স্কুল ছেড়ে না গেলেই হত । এ বিদায় - বেদনা প্রকৃত শিক্ষকদের নিকট কেবল মুখের কথা নয় , উহা হৃদয়ের গভীর অনুভূতি । নদীবক্ষে ষ্টিমারের ঢেউয়ের দোলায় এবং মনে আনন্দ - বেদনার মায়ার খেলা ঈষৎ চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার মধ্যে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি , জানি না । জেগে উঠে চলন্ত ষ্টিমারে রোদের ছটায় স্বপন - ভাঙ্গা আবহাওয়ায় কিছুক্ষণ আবিষ্ট হয়ে রইলাম । মন তখন অনেকটা প্রকৃতিস্থ । পরিবারের লোকজনের আনন্দ কলরবে আমি নিজকে শরীক করে নিলাম । চট্টগ্রামে পৌঁছে শুনলাম সামাদ সাহেব টেলিগ্রাম পেয়ে আমি আসবার আগেই অতি দুঃখ ও মন - বেদনার সঙ্গে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে চলে গেছেন । তাঁর দুঃখ আমি বুঝলাম । এ স্কুলকে তিনি বাস্তবিকই ভালবেসেছিলেন । দেড় বৎসর আমি যে ছিলাম না তাতে স্কুলের উর্দ্ধগতি যাতে ব্যাহত না হয় । তার জন্য যথেষ্ট খেটেছিলেন । হয়ত তাঁর মনে হয়েছিল এ বদলীর ব্যাপারে আমার কিছুটা হাত ছিল । তাঁর সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আমি বাস্তবিকই ক্ষুব্ধ হলাম । তাঁকে দীর্ঘ চিঠি লিখে আমার বদলীর ইতিহাস জানালাম । তিনি ছিলেন দিলখোলা মানুষ , তার উপর আমাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন । পরবর্তী জীবনে আমাদের অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পেয়েছিল । কাজে যোগদান করে স্কুল তরনীর শিথিল রজ্জু দৃঢ় করে ধরলাম এবং নানা দিক দিয়ে একে বিভাগের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর স্কুপ রূপে গড়ে তুলবার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম । শিক্ষকেরা । প্রথম থেকে সকলেই যথাসাধ্য সহযোগিতা করছিলেন । সুতরাং লেখা - পড়ায় , চলাফেরায় , খেলাধুলায় মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্রদের একটি বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছিল । আমাদের নিজস্ব বড় ফুটবল খেলার মাঠ ছিলনা । অনেক চেষ্টা তদবীর করে কলেজিয়েট স্কুলের প্রকাণ্ড ঘেরার মধ্যে পূর্ব্বদিকের কর্দমাক্ত অব্যবহৃত অংশটি মুসলিম হাইস্কুলের বরাবরের জন্য দিয়ে দেয়ার প্রস্তাবটি ইনস্পেক্টার পূর্ব্বকার জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট এবং খেলাধুলার ডাইরেক্টার বুকানন সাহবের দ্বারা জোর সমর্থিত হয়ে ডি , পি , আই , অফিসে পড়েছিল । কিন্তু যুদ্ধের সময় জিলা ম্যাজিস্ট্রেট জেমিসন সাহেব এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বেঁকে বসলেন । ১৯৪০ ইংরেজীতে তিনি জেলার কর্তা হয়ে এসে কি জানি কেন মুসলমানদের প্রতি নানাভাবে বিরক্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে লাগলেন । স্কুল কমিটির , জিলার বয়স্ক শিক্ষা - সমিতির এবং ভিক্টোরিয়া ইসলামিয়া হোষ্টেল কমিটির তিনি সভাপতি ছিলেন এবং আমি ছিলাম সেক্রেটারী । এ সবের প্রত্যেক সভাতেই প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে তিনি ভাল ব্যবহার করতেন না । কোন অভাব অভিযোগরে কথা উঠলেই তিনি বলতেন “ রাজত্ব এখন ফজলুল হক সাহেবের । তাঁর কাছে আবেদন জানাও না । " কিন্তু চার মাস পরে আমার মতের যৌক্তিকতা এবং উদ্দেশ্যের নিঃস্বার্থপরতায় তিনি বন্ধুর মত ব্যবহার করতে লাগলেন । মাঠের ব্যাপারে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করলে , তিনি বললেন “ আমার ছেলেরা এখন অস্ট্রেলিয়ায় পড়ছে , আর নিজের হাতে ট্রেঞ্চ ও পুকুর খনন করছে । তোমাদের ছেলেরাতো সব ভদ্রলোক । হাতের কাজ করা ত তাদের কাছে অপমানকর । ” আমি উত্তরে বললাম , “ দরকার হলে আমাদের ছেলেরা বোমা বানায় , তা ত আপনি জানেন । গ্রাম্য স্কুলের অধিকাংশ মুসলমান ছেলে হাল চষে ও ধান কেটে পড়াশুনা করে আর শহরের যদি দরকার হয় তারা শারীরিক পরিশ্রম করতে পিছপাও হবে না । ” ইতিপূর্বে এক সাহেব সুপারিন্টেল্ডিং ইঞ্জিনীয়ার এই মাঠকে খেলার উপযোগী করার জন্য ত্রিশ হাজার করে পাকা করে দেয়া হল । এখানে এটাও উল্লেখযোগ্য যে , মুসলিম হাইস্কুলকে চট্টগ্রাম শহরের ধনী - দরিদ্র সকল মুসলমান নিজেদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন এবং এর জন্য কিছু কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে তাদের আগ্রহের সীমা ছিলনা । এরূপে খেলার মাঠ পেয়ে স্কুলের ছেলেদের সিনিয়ার ও জুনিয়ার দু'টিমে ভাগ করে পুলিশ অফিসের পাহাড়ের নীচে প্রসিদ্ধ লালদীঘির মাঠে জুনিয়র টিমের খেলা ও এ সদ্য প্রাপ্ত খেলার বড় মাঠ বড় ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট করা হল । তদুপুরি স্কুল গৃহের চারি - পাশে উপরে নীচে সব জায়গা সমান করে Small Area Games এবং সারা বৎসর স্পোর্টসে এর কয়েকটি আইটেম যথা : - High Jump . Pole Jump , Long Jump Hop step and Jump ইত্যাদি অভ্যাস করার বন্দোবস্ত করা হল । এ ব্যাপারে স্কুলের ' বুকানন ' কলেজ পাশ একজন খেলার মাষ্টার জিন্নত আলী সাহেবের উৎসাহ ও সহযোগীতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এ সব ব্যবস্থার ফলে যে স্কুল ইতি পূর্ব্বে জেলার বার্ষিক স্পোর্টসে একটি পুরস্কারও পায়নি সে স্কুল প্রায়ই চেম্পিয়নশিপ পুরষ্কার লাভ করত । এ স্কুলের ফুটবল টিম অন্যান্য টিমকে পরাজিত ত করতই , এমনকি চট্টগ্রাম রেলওয়ে টিমকেও একবার হারিয়ে দিয়েছিল । অন্যান্য স্কুলের ছেলেরা খেলার মাঠে আমাদের টিমের সঙ্গে কোন রূপ অন্যায় ব্যবহার করতে সাহস করত না । কারণ তারা জানত এরূপ স্কুলে অধিকাংশ দর্শক অন্যায়নকারী টিমের উপর মারমুখী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে । ১৯৩৩ ইংরেজীর এপ্রিল মাসে যখন আমি এ স্কুলে যোগদান করি তখন এটার কাহিল অবস্থার কথা বলেছি । বেশ কিছুদিন কারণ অনুসন্ধান করে বুঝতে পারলাম শহরের সমস্ত হিন্দু কর্মচারী ও শিক্ষিত ভদ্রলোকদের দেখাদেখি মুসলমান সরকারী চাকুরিয়া ও বড়লোকেরা তাঁদের ছেলেদের কলেজিয়েট অথবা মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলে ভর্তি করতেন । আর দরিদ্র শ্রেণীর স্থানীয় মুসলমান ছেলেরা এবং গ্রামাঞ্চলের অবস্থাপন্ন কিছু ছেলে মুসলিম হাইস্কুলে ভর্তি হত । এখানে বেতন ছিল অর্ধেক এবং শাসনের কড়াকড়িও ছিল কম । আমি সামাদ সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৯৩৪ ইং হতে গরীব অথচ মেধাবী ছেলেদের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য দেয়ার এবং বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়বার ব্যবস্থা করেছিলাম । ৩৮ সাল থেকে কর্ণফুলীর দক্ষিণ হতে টেকনাফ পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চলের গরীব মেধাবী ছেলেদের জন্য বিনা পয়সায় খাবার ও থাকবার বন্দোবস্ত করলাম । শর্ত ছিল তারা নিজেরা পাক করে খাবে । এতেও বেশ কিছু সংখ্যাক ভাল ছেলে আসতে লাগল । শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে নয় জেলার অন্যান্য স্থান থেকে আগত মেধাবী ছেলেদের জন্যও অনুরূপ ব্যবস্থা করা হল । এটা নানা উপায়ে বড়লোকদের সাহায্যে করা হয়েছিল । কাজেই দু'তিন বৎসরের মধ্যে স্কুলের রূপ বদলে গেল এবং সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল । নিয়ম - শৃঙ্খলা ও ভদ্র চাল - চলন বজায় রাখার দিকে কড়া নজর রাখা হল । এর ফলে ভর্তির জন্য ভিড় অনেকটা বেড়ে যায় । কিন্তু আমি বড়লোক ও সরকারী চাকুরিয়ার ছেলেদের চেয়ে গরীব সাধারণ লোকের ছেলেদেরই অধিক সংখায় ভর্তি রতাম । ১৬১ ১৯৪০ ইংরেজীর মাঝামাঝি আমাকে নোয়াখালী জিলা স্কুলে বদলী করা হয় । আমি নিজের থেকে বিশেষ কিছু করলাম না । কিন্তু সাধারণ বন্ধু - বান্ধব ও স্কুলের হিতাকাঙ্খীরা ক্ষুব্ধ হয়ে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট , ডি.পি , আই ও শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে অনেক টেলিগ্রাম , চিঠিপত্র ও আবেদন পাঠিয়েছিলেন । সব খান বাহাদুরেরা ও আইন সভার সদস্যরা একযোগে টেলিগ্রাম করলেন । জেমিসন সাহেবের সঙ্গে তখন আমার বেশ খাতির । তিনি এ ব্যপারে ডি.পি.আই সাহেবকে এক কড়া চিঠি লেখেন । তাতে লিখেছিলেন যে , যুদ্ধের ঘনঘটা ঘনিয়ে আসার সময় তাঁকে না জানিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করা উচিত হবে না । জেমিসন সাহেবের এ কড়া চিঠি পেয়ে ডি.পি , আই এর চক্ষু স্থির । পূর্ব্বেই বলেছি , জেমিসন সাহেব ছিলেন এক প্রতিভাবান ব্যক্তি । বাঙ্গালা সরকারের নিকট তাঁর প্রতিষ্ঠাও ছিল খুব উঁচু মনের । বিশেষতঃ তাঁর মত সুদক্ষ কর্মচারী যিনি ভারতের সীমান্ত প্রহরায় নিযুক্ত ছিলেন , তাঁকে নাখোশ করার সাহস অন্ততঃ শিক্ষা বিভাগের ছিল না । তাই বিষয়টি ধামা চাপা দিয়ে রাখা হল এবং এর পর প্রায় এক যুগ আমাকে চট্টগ্রাম ছাড়তে হয়নি । ১৯৪১ ইং শেষের দিকে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে , চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকূল যেন এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিবাত্যায় সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্থ হয়েছে । সুতরাং ভয় পেয়ে আমি শহরের বাইরে বাকলিয়া গ্রামে এক বাসা ভাড়া করে রাখলাম । সেখানে ভদ্রলোকের আস্তানা ছিল না । গাড়ীওয়ালা , চাওয়ালা ও কৃষক ও সামান্য দূরে পশ্চিমাদের বড় বড় আড়ত ছিল । মিনিসিপ্যালিটির বাইরে হওয়ায় লাইটেরও কোন বন্দোবস্ত ছিল না । মনে করেছিলাম এ সব স্থানে বোমা পাড়বে না । জাপানীরা টেকনাফ নদীর তীরে এসে আস্তানা গাড়ায় ১৯৪২ সালের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহরবাসীরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ল । স্কুল কলেজ ও সব বন্ধ হয়ে গেল । আমার স্কুল সম্বন্ধে কি করা যাবে তা নিয়ে বিশেষ দুর্ভাবনায় পড়লাম । মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল আমার নিজ ইউনিয়ন পটিয়ার ভাটিখাইন গ্রামে একটি এম ই স্কুলকে কেন্দ্র করে বসতে আরম্ভ করল । পুরানো ছাত্র খুব কমই গেল । এ সময় একটি আশ্বর্য্য স্বপ্ন দেখি । দেখলাম , আমি বর্তমান মুসলিম হাইস্কুলের দক্ষিণের দ্বিতল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি । দক্ষিণপূর্ব্ব দিকচক্রবাল রেখার ওপার থেকে সোনার সিংহাসন পিঠে এক হাতি উড়ে এসে যেখানে কুয়াশা ঢাকা পাহাড় চূড়া আবছায়া নীলাকাশের মায়ায় ঘেরা রহস্য জগত সৃষ্টি করেছে সেখানে হঠাৎ নেমে পড়ল । আর সামনের দিকে আসল না । তখন আমার মনে হল , জাপানীরা বার্মা সীমান্ত অতিক্রম করে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হবে না । ভবিষ্যৎ ঘটনাবলীও তাই প্রমাণ করেছিল- কিছুদিন পরে আমাদের স্কুলকে মোমেনশাহী জিলার সদরে স্থানান্তরিত করবার হুকুম এল । এ নিয়ে স্কুল কমিটির মিটিংয়ে আমি জেমিসন সাহেবকে বুঝিয়ে বললাম যে , এ স্কুল মোমেনশাহীতে সরিয়ে নেয়ার অর্থ শিক্ষকবৃন্দ বইপত্র ও আসবাবপত্র কেবল সরিয়ে নেয়া । এখানকার দরিদ্র মুসলমান ছেলেদের কেউই সেখানে পড়তে যাবে না । সুতরাং মোমেনশাহীতে একটি নতুন স্কুল করা ব্যতীত এর আর কোন অর্থ হয়না । মিউনিসিপ্যালিটির নাম মাত্র বাইরে একটি দ্বিতল বিল্ডিং এবং তৎসংলগ্ন কয়েকটি ঘর আছে । সেখানে যদি স্কুল নিয়ে যাওয়া হয় তবে এ স্কুলের ছেলেরা ত পড়তে পারবেই তাছাড়া স্থানীয় এংলোইণ্ডিয়ান , হিন্দু ও বৌদ্ধ ছেলেরাও পড়ার সুযোগ পাবে । যেহেতু এ শহরে অন্য কোন স্কুল নেই সুতরাং নাম মাত্র শহরের বাইরে এ স্কুল বসলে শহর এবং উপকন্ঠের পড়ুয়া ছেলেদের পড়ায় ছেদ্ পড়বে না । আর এ অঞ্চলও শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হয়ে বন্য যুগে ফিরে যাবে না । তামাসাচ্ছলে তাকে আরো একটি কথা গোপনে বললাম যে , জাপানীরা কখনও চট্টগ্রামে আসবে না । তাঁরা যেখানে আছে , সেখান থেকেই আমাদের উপর উৎপাত চালাবে । সাহেব শুনে হেসে হেসে বললেন “ তুমি কি করে জান ? ” উত্তরে জানালাম যে আমরা অর্থাৎ প্রাচ্য দেশীয় লোকেরা সুপার ন্যাচারেল বা আধিভৌতিক জগতে বিশ্বাস করি এবং ইশারা ইঙ্গিতে ভবিষ্যতের বিচিত্র ঘটনাবলীর কিছুটা অগ্রিম আভাস পাই । যা হোকঃ অবশেষে তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে খান বাহাদুর হাজী মিঞা খাঁ সওদাগরের পূর্ব্ব বর্ণিত দ্বিতল গৃহ এবং তৎসংলগ্ন টিনের ছাউনি পাকা দেয়ালের বাড়ীগুলি ভাড়া করে সেখানে আমরা উঠে গেলাম । ১৯৪২ ইংরেজী মার্চের প্রথম থেকে তথায় ক্লাস বসতে লাগল । এখানে বলে রাখা ভাল যে মাষ্টারী করলেও আমি আমার ব্যক্তিগত মর্যাদা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলাম । মাষ্টার বলতে যে , নিরীহ নির্জীব প্রাণীকে বুঝায় , আমি তা কখনই ছিলাম না । কোন কারণেই কারো নিকট এ মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় , এমন ব্যবহার করতাম না । বন্ধু - বান্ধব ছাড়া কোন বড় অফিসারের নিকট যেতাম না । এটা আমার ডেপুটিগিরি হারাবার দরুণ মনে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সম্পর্কে যে Inferiority Complex বা হীনতা বাধ জন্মেছিল , তারই ফল কিনা জানিনা । সাহেব - সুবাদের বিশেষতঃ গুণী অথচ গুণাগ্রহী উর্দ্ধতন কর্মচারীদের প্রতি আমার কোন শঙ্কা - শঙ্কোচ ও ভয় ত্রাসের ভাব ছিল না । তাঁদের আমি নিজের সমকক্ষ মনে করতাম । অনেক চেষ্টার ফলে এ অহংবোধ বর্তমানে কিছুটা কমেছে । কিন্তু একেবারে নির্মূল হয়েছে বলা যায় না । স্কুল - কলেজে পড়বার সময় শিক্ষকদের এবং উচ্চ শ্রেণীর ভাল ছাত্রদের সঙ্গে অধিকতর মেলামেশার ফলে এবং পরবর্তী জীবনে ভাগ্যের নিষ্ঠুর আঘাতে ধরাশায়ী হওয়ায় এ মানসিকতা জন্ম লাভ করেছিল । কয়েকটি উদাহরণ দিলে আমার নিজের চরিত্র সম্বন্ধে সঠিক ধারনা করতে কিছুটা সুবিধা হবে । আগেই বলেছি নীচের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে আমার বিশেষ মেলামেশা ছিল না । কিন্তু আমার দুই তিন ক্লাস উপরের ভাল ছেলেদের সঙ্গে ভাব ছিল । কারণ তাদের সঙ্গে তাল রেখে আমি বাংলা ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারতাম । গভীর ব্যাপক না হলেও আমার Extensive অধ্যয়নের বিষয় শিক্ষকেরা জানতেন । সে জ তাঁরা আমাকে খাতির করতেন । কলেজেও আমার এ ভাবে কেটেছিল । কাজেই নিজেকে সাধারণের চেয়ে ভাল মনে করার একটি সঙ্গত কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম । আমি যে উত্তম পুরুষ " তা শুধু ব্যাকরণের বইতে নয় জীবনের ক্ষেত্রেও আমি বিশ্বাস করতাম । আমার অধ্যাপকদের ধারণা আমি ফার্স্ট ক্লাস অনার্স পাব । তা না পাওয়াতে তাদের বিদ্যা - বুদ্ধি সম্পর্কে আমার সন্দেহ জন্মে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে এ সন্দেহ আরো বেড়ে যায় । বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব লোক আরবী , ফার্সী , বাংলা , দর্শন ও ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতেন , তাঁদের সম্বন্ধে আমি কখনও উচ্চ ধারনা পোষ করতে পারি নি । সিলেটের এক অর্ডিনারী বি . এ পাশ ছেলে মুখস্থ করে ইতিহাসে ফার্স্ট ক্লাশ পাওয়ায় আমার এ ধারনা আরও বন্ধমূল হয় । Mr. C. L. Wrenn Dr. Nag ছাড়া অন্যান্য সব ইংরেজী অধ্যাপকদের সম্বন্ধে ও আমার কিছুমাত্র শ্রদ্ধার ভাব ছিল না । ডাঃ এস.কে.সে বিলেতে Sanskrit Poeticus লিখে Ph.D. ডিগ্রী পান । অথচ তিনিই হলেন ইংরেজীর ব্রীডার । অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা ও গবেষণার জন্য নিযুক্ত করা হয় । ভারত সরকার মহাভারতের এক আধুনিক সংস্করণ তৈরী করার জন্য যে সম্পাদনা - বোর্ড স্থাপন করেন , তাঁকে তার সভাপতিরূপে বাংলার বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে বোম্বের আরব সাগরের উপকূলে নিয়ে যান । বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ছাত্রদেরও ডিপুটি , মুন্সেফ , ইনকামট্যাক্স অফিসার , এমনকি অধ্যাপক ও শিক্ষা বিভাগের ভাল চাকুরীর মোহ ও অহমিকা এমনি পেয়ে বসে যে , তাঁদের শতকরা ৯৯ জনের অধ্যয়ন স্পৃহা , জ্ঞান পিপাসা ও চাকুরী লাভের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুচে যায় । এ সব দেখেশুনে দেশের উচ্চ শিক্ষিত চাকুরিজীবী ও অন্যান্য লোকদের সম্পর্কে আমার হীন ধারনা ও অবজ্ঞার ভাব কখনো ঘুচেনি । বাংলার মুসলমান লেখকদেরও দু'তিন জন্য ব্যতীত অন্যান্যদের জ্ঞানের গভীরতা ও প্রসার অত্যন্ত কম । ভাগ্যের চক্রান্তে যাঁরা আমার চেয়ে জীবনে অধিকতর পদমর্যাদা ও যশঃখ্যাতি লাভ করেছেন , তাঁদের সম্পর্কে আমার কোন দিনই শ্রদ্ধার তার ছিল না । তদুপুরি আমার ভুলের বা ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে আমি জীবনের এক ক্ষুদ্র পরিসরে ও অজ্ঞাত ক্ষেত্রে নিজেকে নির্ব্বাসিত করে রেখেছিলাম বলে আমার চেয়ে উচ্চতর পদমর্যাদার অধিকারী ও যশঃখ্যাতির মুকুটধারীদের প্রতি উপেক্ষার ভাব প্রদর্শনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম । আমি সরকারী স্কুলের হেড মাষ্টার হলেও অ্যাচিত ভাবে কখনও কোন বড় চাকুরিয়ার সঙ্গে দেখা অথবা ভাব করতে চাইনি । এস.ডি.ও , সাব জজ , পুলিশ সুপার , ইন্সপেক্ট্রার এমনকি অনেক ডিরেক্টারকেও বড় মনে করতাম না । আমি আমার সহকর্মী ও সহধর্মীদের ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে উট পাখির মত মরুবালির স্তূপে গর্ত খুঁড়ে মুখ লুকিয়ে থাকতাম । আমি সারা জীবন বিনা আহ্বানে কোন উর্দ্ধতন কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করিনি । হেডমাষ্টার ও ইন্সপেক্টার হিসাবে কোন কালেক্টার , কমিশনার বা নিজের উর্দ্ধতন কর্মচারীর বাড়ীতে কোন পৰ্ব্ব উপলক্ষে অন্যান্য কর্মচারীদের মত সালাম ঠুকতে চাইনি । তবে যাঁরা নিজ হতে আমার সঙ্গে ভাব করতে চাইতেন তাঁদের সঙ্গে আমার বেশ খাতির জমত । বাবু দিগেন সাহা নামে এক সিনিয়র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খুলনায় বদলী হয়ে তার দু'পুত্র নিয়ে আমার বাসায় দেখা করেন । ভদ্রলোকের কথাবার্তার ধরনে ও সৌজন্যে আমি মুগ্ধ হলাম । কথায় কথায় জানতে পারলাম , তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়েছিলেন । ইতিপূর্বে আমি অনুরূপ কোন লোক দেখিনি । তাই সহর্ষে উঠে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করলাম এবং তাঁর দু'ছেলেকেই ভর্তি করব বললাম । বড় ছেলেটি দশম শ্রেণীতে পড়ত । সে পনের টাকার বিভাগীয় বৃত্তি পেল এবং সেই বছরে তারই সঙ্গী এক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করল । আমার কোন ছাত্র ম্যাট্রিকুলেশানে ফাৰ্ষ্ট হয়নি । চট্টগ্রামে হেড মাষ্টার থাকা কালে যুদ্ধের কিছু পূর্ব্বে এক জবরদস্ত এস.ডি. ও’র বাসায় যাবার জন্য আমার এক বন্ধু ডিপুটি তাহের সাহেব অনুরোধ করলেন । সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন , আমি যেন রিটার্ণ ভিজিট আশা না করি । কাজেই আমি গেলাম না । তিনি ছিলেন অনারারী মেজর এবং অপুত্রক । কিছুদিন পরে তাঁর এক ভাইপোকে নিয়ে তিনি আমার স্কুলে এসে উপস্থিত । সীট নাই বলে আমি তাঁকে অতি অল্প কথায় বিদায় করলাম । তিনি অনেক করে বললেন , যেন আমি তাঁর অনুরোধটা রাখি । কিছুদিন পরে তিনি আবার এসে বিশেষ করে ধরে বসলেন । তখন আমি তাঁর ভাইপোকে নিলাম । খুলনায় কিন্তু অন্যান্য চাকুরিয়ারা হেডমাষ্টারকে তোয়াজ করতে অসম্মান বোধ করতেন না । চট্টগ্রামে এক এস.ডি. ও বদলি হয়ে এসে তিন মাসের মধ্যেও আমার সঙ্গে দেখা না করে যুদ্ধের প্রথম দিকে কি একটা ব্যাপারে সব হেডমাষ্টারকে তাঁর বাসায় ডেকে পাঠান । আমি নোটিশ বইতে লিখে দিলাম , যেহেতু তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই এবং তাঁর বাসাও আমি চিনি নে কাজেই আমার পক্ষে তার বাসায় যাওয়া সম্ভব হবে না । কলেজিয়েট স্কুলের হেড মাষ্টারকেও বলে পাঠালাম , তিনিও যেন না যান । তিনি লিখেছিলেন তাঁর শরীর অসুস্থ । নির্দিষ্ট দিনে আমাদের অনুপস্থিত থাকাতে মিটিং হল না । আমি তিনটার কিছু পরে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে হুকা দিয়ে বসতেই খবর এল . এস . ডি . ও সাহেব এসেছেন । দেখা হতেই তিনি হেসে বললেন “ আমি বুঝেছি কেন আপনি যান নি । আমার ভুল হয়েছে , এখন থেকে আর তা হবে না । " এ বলে কিছুক্ষণ গল্প করে চা খেয়ে চলে গেলেন । এর অল্পদিন পরেই লালদীঘির ময়দানে আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে দু ' প্রতিদ্বন্দ্বী দলের এক পক্ষকে তিনি ঈদের নামাজ পড়বার অনুমতি দিয়েছিলেন । অথচ চিরকাল মুসলিম হাই স্কুলের হেডমাষ্টারের সুপারিশ মোতাবেক উপযুক্ত ক্ষতি পূরণের টাকা জমা রেখে জিলা ম্যাজিস্ট্রেটই এ অনুমতি দিতেন । তিনি জানতেন না যে , আমরা ইতিপূর্ব্বে অন্য পক্ষকে অনুমতি দিয়েছি । এস.ডি. ও সাহেবের এরূপ অনধিকার চর্চ্চার বিরুদ্ধে আমি জেমিসন সাহেবকে মুখোমুখি অনুযোগ করলাম এবং তিনি যে সব যুবকদের বিরুদ্ধে আমি জেমিসন সাহেবকে মুখোমুখি অনুযোগ করলাম এবং তিনি যে সব যুবকদের সাথে মেলামেশা করেন তাদের সম্বন্ধে ও সঠিক বিবরণ দিলাম । শুনে সাহেব উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন এবং এ ব্যাপারে তাঁর নিকট কৈফিয়ৎ চেয়ে বসলেন । তাঁর দেয়া অনুমতিও নাকচ করে দিলেন । তাঁর কৈফিয়তে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি তাঁকে অবিলম্বে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সরকারকে লিখলেন । সপ্তাহের মধ্যেই তিনি বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন । এ ডেপুটি প্রবর পরে এ বিভাগের কোন এক জেলার ডি.সি হয়ে স্থানীয় জামে মসজিদে শুক্রবারে ঈমামতি করতেন এবং পীর সাহেব সেজে আপন বাসায় জিকির আজকারের শোরগোলে রাত্রি ভোর করতেন । তাঁর এসব বুজুরকি অল্পদিনের মধ্যেই লোকচক্ষে ধরা পড়ে এবং ক্রমে ক্রমে তাঁর পীরগিরিও খতম হয়ে যায় । এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা বর্ণনা করে আমি বুঝাতে চাই যে , কিরূপে আমার আত্মমর্যাদা - বোধ এমন তীক্ষ্ণ ও প্রখর হয়ে সুযোগ পেলেই আমার অপেক্ষা উঁচু দরের সামাজিক লোকদের আঘাত করতে ছাড়ত না এবং আমাকেও তাঁরা অহংকারী বলে অপবাদ দিতেন । তথাকথিত শোষিত জনগণের মনে অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থার লোকদের যে সহজাত বিদ্বেষের ভাব দেখা যায় , হয়ত আমার অবচেতন মনেও সেই একই প্রবণতা অবস্থা বিপাকে জন্মলাভ করেছিল । প্রথম জীবনে দারিদ্র্যের চাপ ও রোগের প্রতাপ এবং পূর্ণ যৌবনে ভাগ্যের অভিশাপ আমার স্বাভাবিক প্রতিভা ও কর্মদক্ষতা অপেক্ষাকৃত পঙ্গু ও নিষ্প্রভ করে রাখার ফলেই হয়তঃ এ চারিত্রিক দুর্বলতা জন্মলাভ করেছিল । শিক্ষক জীবনের প্রথম মাস হতেই আমার স্বল্প বেতনের কিছু অংশ গরীব ছাত্রদের জন্য ব্যয় করতাম । পদোন্নতি ও আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে এ সাহায্যের পরিধি ছাত্র সমাজ ছাড়িয়ে জনসমাজেও প্রসারিত হয়ে চলল । এখনও তা বেড়েই চলেছে । যদিও আমার ব্যক্তিগত আয় কমেছে এবং ব্যয় বেড়েছে , তথাপি আমার ছেলের ও ভাইয়ের আয় থেকে আমি নিজ হাতেই এ টাকা খরচ করি । চট্টগ্রামের খুব গরীব ভাল ছেলে আছে , যারা কোন না কোন সময়ে আমার থেকে অথবা মাধ্যমে অর্থ সাহায্য বা অন্যপ্রকার সাহায্য লাভ করেনি । এখন যদিও সরকারী বৃত্তির সংখ্যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়েছে তথাপি যে সব ক্ষেত্রে গরীব ছাত্রদের এ সাহায্য কুলায় না তাদেরকেও আমাকে সাহায্য করতে হয় । পাকিস্তান হবার পর অনেকগুলি প্রাদেশিক দপ্তরের হেড কোয়ার্টার্স চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা হয় । এমনকি এরূপ আশাও অনেকে পোষণ করতেন , হয়ত চট্টগ্রামে প্রাদেশিক রাজধানী স্থাপিত হবে । কিন্তু এক মাসের মধ্যে দেখা গেল এখানে স্থানাভাববশতঃ ঢাকাই অধিকতর উপযোগী হবে । পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরে অনেকগুলি দপ্তরের জন্য উপযুক্ত ইমারত তৈরী করা হয়েছিল । এ স্বল্পকাল স্থায়ী বিরাট প্রদেশ বিলুপ্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে এর রাজধানীর জন্য তৈরী ইমারতগুলি হাওয়ায় উড়ে যায়নি । প্রায় দশ বৎসর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও অধ্যাপকমণ্ডলীর জন্য এসব রাজকীয় প্রাসাদ ব্যবহৃত হতে থাকে । সেখানে আরো একটি সুবিধা ছিল । ঢাকা শহরের উত্তর , পশ্চিম ও পূর্ব দিকের বিস্তৃত এলাকা বিনা ব্যবহারে অপচিত হচ্ছিল । এ শহরে অনেক হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ী বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বাগান বাড়ী বা কেবল আম কাঠালের বাগান করে রেখেছিলেন । বহু সংখ্যক হিন্দু ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার ফলে স্বল্প মূল্যে বা বদলাবদলীর মারফত অনেকগুলি খালি ঘরবাড়ী ও বাগানবাড়ী সহজলভ্য ছিল । চট্টগ্রামে কিন্তু এসব কোন সুবিধাই ছিল না । প্রাদেশিক বাণিজ্যের প্রধান বন্দর ও কেন্দ্র ই , বি , রেলওয়ে ও বিভাগীয় হেড কোয়ার্টার্স ব্যতীত এর অন্য কোন গুরুত্ব ছিল না । সুতরাং চট্টগ্রামবাসী রাজধানী নিয়ে টানাটানি করলনা । তবু কয়েকটি দপ্তরের হেড - কোয়ার্টার্স এখানে স্থাপিত হল । কেন্দ্রীয় কাষ্টমস্ , আমদানি রফতানি আয়কর ও আবহাওয়া বিভাগ এবং প্রাদেশিক বস্তু , শিল্প ও শিক্ষা বিভাগের হেডঅফিস এখানে খোলা হয় । একে ত এখানে বাড়ী ঘরের সংখ্যা কম । তদুপরি হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির ভাব অক্ষুণ্ণ থাকায় হিন্দুর পরিত্যক্ত কোন বাড়ী ঘর সরকারী অফিস আদালতের জন্য পাওয়া অতি দূরূহ ছিল । সুতরাং যে কয়েকটি অফিস এখানে স্থাপিত হল এবং Option এর ফলে যে মুসলমান কর্মচারীবৃন্দ এখানে এসে পড়লেন , তাঁদের জন্য অনেকগুলি ঘরবাড়ী আইনের বলে জবরদমূল করা হয় । তাও আবার ইচ্ছামত কম ভাড়ায় । মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির সেক্রেটারীরূপে আমাকে সৰ্ব্বপ্রথম বৃহৎ ত্রিতল ভিক্টোরিয়া হোষ্টেল গৃহটি নবাগত অফিসারদের অস্থায়ী পান্থশালা রূপে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিতে হল । তারপর মুসলিম হাইস্কুলকে কলেজিয়েট হাই স্কুল গৃহে সকাল বেলায় বসাবার ব্যবস্থা করে স্কুলের গৃহাদি নবাগত দপ্তর গুলির ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেয়া হল । ইনকাম ট্যাক্স দপ্তরের হেড অফিস পরীর পাহাড়ের ত্রিতল কোর্ট বিল্ডিং এর দু'তিনটি কামরায় বসাতে হল । শিক্ষা দপ্তর যোগেশ বাবুদের টিলাস্থিত একতলা বাড়ীতে কোন মতে কাজ চালাতে লাগল । মাস কয়েকের মধ্যেই নবাগত অফিসারদের কোন রকমের মাথা গুজাবার স্থান সংকুলান হলে পর ভিক্টোরিয়া হোষ্টেল প্রায় খালি হয়ে গেল । পাকিস্তান হবার কিছু পরে জনাব এফ , এ , করিমকে শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারী রূপে ঢাকায় বদলী করা হয় এবং তাঁর স্থলে জনাব নাসির উদ্দিন সাহেব জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট হয়ে আসেন । তিনি প্রাদেশিক সরকারের চাকরি হতে বিভাগ পূর্ব্ব ষ্টীল ফ্রেইমের শূন্য চেয়ারে বসে অহংকারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন । পরনে হাফ প্যান্ট , মাথায় হেট , হাতে রাজদও নিয়ে জীপে করে মিলিটারী মেজাজে শুরে বেড়াতেন । তাঁর কাছ থেকে একদিন এত্তালা পেলাম দুই দিনের মধ্যে যেন স্কুল গৃহ খলি করে দিয়ে আমরা মিউনিসিপ্যাল স্কুলের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে সেখানে চলে যাই । এর দু - তিন দিন পরে তিনি স্বয়ং বিভাগীয় ইন্সপেক্টার সহ স্কুলে আসেন । সাহেব সালামের জবাব না দিয়ে আমাকে বললেন , " আপনি স্কুল খালি করে দেন নি কেন ? " উত্তরে আমি বললাম , “ সে অনেক কথা- তার মধ্যে প্রধান কথা হচ্ছে এটা মুসলমান কুল , ওটা মিশ্র স্কুল " শুনে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে কিছুক্ষণ গাড়ীতে বসে আস্ফালন করে চলে গেলেন । " উপরি ক্লাশের ছেলেরা এসব লক্ষ্য করছিল । তাঁরাই আমার সৈন্য - সামন্ত । যে কোন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে মোকাবেলা করতে তারা প্রস্তুত । তিনি চলে গেলে পর ছেলেরা তাঁদের মনের ক্ষোভ আমার কাছে প্রকাশ করাতে আমি দৃঢ় কণ্ঠে তাদের বারণ করলাম । কিন্তু তাঁর এখনি দুর্ভাগ্য যে , দু'তিন দিন পরে তিনি আবার স্কুলে এসে মিলিটারী মেজাজ দেখান । এতে ছেলেরা আরও ক্ষেপে যায় । তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে জেনারেল পোষ্ট অফিসের সামনা সামনি কমার্স কলেজে গেলেন । সামাদ সাহেব তখন এ কলেজের প্রিন্সিপাল । তাঁকেও আদেশ দেয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম কলেজে সরে যাওয়ার জন্য । সে বেচারা অসুবিধার কথা তুলতেই তিনি বললেন " Eduction can wait . But administration can not You Must vacate " সেখান থেকে আমরা কলেজিয়েট স্কুলের দিকে চললাম । অল্পদূরে যেতেই মনে হল যেন তাঁর মেজাজ কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে । বললেন “ দেখুন ভাই , আমি কলেজিয়েট স্কুলের সুন্দর ঘরগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দিতে চাই না । তাঁর চেয়ে বরং আপনার ঐ পুরাতন আধার ঘরটাই দিয়ে দেন । ” তখন আমিও সুর নরম করে বললাম , “ অবশ্য বেশী অসুবিধা না হলে আমার কোন আপত্তি নেই । " তৎপর আমরা সে স্কুলে ঘুরে ঘুরে দেখে সব ঠিক করলাম । তখন তিনি হুকুম করলেন , “ চালাও নন্দনকানন , মেয়েদের স্কুলে । ” সেখান থেকে এসে গাড়ীতে উঠে পড়লেন । তখন প্রায় বেলা একটা । কিছুদূর যেতেই বর্ত্তমান মুসলিম ইনষ্টিটিউটের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে আমায় নেমে যেতে বললেন । আমি তাঁকে বাসায় পৌছিয়ে দিয়ে সে গাড়ীতে করে স্কুলে চলে যাব বলাতে তিনি বললেন , “ কেন আপনি হেঁটে যেতে পারবেন না ? " আমি বললাম , " দুপুর রোদে আমার হাঁটার অভ্যাস নেই " । তিনি ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলেন , “ আপনার বয়স কত ? " বললাম " ৪৭। " আমার বয়স কত জানেন ? ছাপ্পান্ন । " But I can run this distance in the sun " আমি যখন কিছুতেই নামি না তখন সোফারকে স্কুলের দিকে গাড়ী ফেরাতে বললেন । তিনি শুনেন মত আমি স্বগত ভাবে বল্লাম , “ স্যার মেডিকেল বোর্ড ঠিকই ধরেছিল , আমি রোদে দৌড়াদোড়ি করতে পারবনা । তাই আমার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটগিরিটা কেড়ে নিলেন । না হয়ত আজকে আমি সেক্রেটারী বা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হতাম । স্কুলে মাষ্টারী করতাম না ” । তখন তিনি মুখ ফিরিয়ে বললেন “ Very Sad . কি হয়েছিল বলেন ত ? " তখন আমি তাকে বি , সি , এস পরীক্ষা ও মেডিক্যাল বোর্ডের কাহিনী শোনালাম । তিনি স্কুলের কাছে এসে আমাকে নামিয়ে দিলেন । এসব কথা শাখা প্রশাখায় বিস্তারিত হয়ে ছাত্রমহলে ছড়িয়ে পড়ল । আমার অজ্ঞাতে তারা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে একাটা আন্দোলন গড়ে তুলল । একদিন সন্ধ্যায় কোতোয়ালী থানার দারোগা সাহেব আমাকে জানালেন যে , হাজার হাজার ছাত্র ম্যাজিস্ট্রেটের পাহাড় ঘেরাও করে আছে । আর শ'পাঁচেক তাঁর বাগান নষ্ট করে এবং ঘরের কাঁচের দরজা ভেঙ্গে ভীষ গণ্ডগোল বাধিয়েছে । সাহেব তাকে অনতিবিলম্বে পুলিশরক্ষী সহ যেতে বলেছেন । আমি বললাম , " আপনি গিয়ে ছাত্রদের দু'চার জনের সঙ্গে সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়ে ঠাণ্ডা করে গোলমাল মিটিয়ে দেবেন । ” সে সময় ডি . এম . এর ভাগ্নে জনাব আনোয়ারুল হক ছিলেন এ জেলার পুলিশ সুপার , পরে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদির ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন । তিনি ছিলেন একজন স্বল্পভাষী , কোমল প্রকৃতির ও কর্তব্যপরায়ণ লোক । কোতোয়ালীর অফিসার আমার কথা মত ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোয় গিয়ে গোলমাল মিটমাট করে দিলেন । মুসলিম হাইস্কুল যথা সময় কলেজিয়েট হাই স্কুল গৃহে সকাল বেলায় বসতে লাগল । মনে হল ছাত্র মহল ঠাণ্ডা হয়েছে । কিন্তু কিছুদিন পরে শিক্ষা মন্ত্রী সাহেবের হঠাৎ এখানে শুভাগমন হল । ছাত্র মহল ঠাণ্ডা হয়েছে । কিন্তু কিছুদিন পরে শিক্ষা মন্ত্রী সাহেবের হঠাৎ এখানে শুভাগমন হল । স্কুলে ছাত্রাবস্থায় মন্ত্রী জনাব আবদুল হামিদ সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল । তিনি প্রায় দু’বছরের কাছাকাছি বি . এল . পাশ করার পর রাহাত আলী হাইস্কুলে শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক রূপে কাজ করেছিলেন । আমি পটিয়া হাই স্কুলে পড়লেও স্কুলের কয়েক ঘণ্টা ছাড়া সকাল বিকেল প্রায় রাহাত আলী স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে মিলে মিশে কাটাতাম এবং হামিদ সাহেবের নিকট ইংরেজীর অনেক কিছু শিখতাম । এজন্য তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন । তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১৯২২ খৃষ্টাব্দে যখন তিনি কংগ্রেসের সভা উপলক্ষে ডেলিগেট হিসেবে চাটগাঁয় এসে কাজিম আলী স্কুল গৃহে ছিলেন । আমি তখন বি , এ , ইংরেজীতে অনার্স পড়তাম । মন্ত্রী সাহেবকে সম্বর্ধনা জানাবার জন্য ষ্টেশনে শিক্ষা বিভাগের সমুদয় কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন । ডি.পি.আই. এর অফিস তখনও চাটগায় ছিল । জেলা ম্যাজিস্ট্রেট , পুলিশ সুপার , সরকারী কর্মচারীরা এবং স্থানীয় ভদ্রলোকেরাও ছিলেন । এই ভিড়ের মধ্যে আমাকে তিনি চিনতে পারেননি । হেড মাষ্টার হিসেবে দেখা করতে গেলে তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন , " আপনার বাড়ী কোথায় ? ” আমি পটিয়া বলাতে তিনি প্রশ্ন করে বসলেন , “ সেখানে আবদুর রহমান ও বিনোদ ভট্টাচার্য কি করে ? ” । আমি বললাম “ আবদুর রহমান আপনার সামনে । একটি সরকারী স্কুলের হেডমাষ্টার । আর বিনোদ ভট্টাচার্য্য এক বেসরকারী স্কুলের হেডমাষ্টার । ” তিনি হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন । বললেন “ তোমাকে আমি চিনতে পারিনি , কিছু মনে করো না ” । আমি বলালম , " বিনোদকে খবর দেব । সে সংবাদ পেলে নিশ্চয় আসবে । " ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে । শুনলাম ম্যাজিস্ট্রেট ও ডি.পি.আই এর অনুরোধে তিনি চট্টগ্রামে এসেছেন ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর গোলমালের বিষয় তদন্ত ও মীমাংসা করতে । তিনি এসে ডি.পি.আই এর বাড়ীতে উঠলেন । সেটা ছিল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পাহাড়ের সংলগ্ন সমতল ভূমিতে । ছাত্ররা ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ডি.পি.আই এর বাসা ঘিরে ফেলে হৈ হল্লা করছিল এবং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছিল । চা খাবার পর মন্ত্রী সাহেব বাইরে এসে ছাত্রদের শান্ত থাকতে বললেন এবং তিনি তাদের যা কিছু অভাব অভিযোগ সে সম্বন্ধে বিবেচনা করে দেখবেন , আশ্বাস দিলেন । এর পর তারা ম্যাজিস্ট্রেট বিরোধী ধ্বনি করতে বিরত থাকে । এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বাইরে এসে অতি নিরীহ ভদ্রলোকের মত অশ্রুসজল কণ্ঠে ছাত্রদের বললেন " আমার নিজের ছেলে পিলে নেই , তোমাদিগকে আমি নিজের ছেলের মতই দেখি । আমি যদি কথা ও কাজে তোমাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি সেটা সমাজের এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্যই করেছি । আমার নিজের সুবিধার জন্য করিনি । কিন্তু তাঁর ব্যবহারে ছাত্ররা এতই রুষ্ট হয়েছিল যে , তাঁরা তাঁর কোন কথাই শুনতে চাইল না । তারা দাবী করে বসল তাকে ক্ষমা চাইতে হবে । অবস্থা সুবিধার নয় দেখে তিনি ভিতরে চলে গেলেন । ডি.পি.আই. ও মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে অনেকক্ষণ পরামর্শের পর দুপুরের খাওয়ার জন্য এ দু'জনকে তিনি তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন । ছেলেরাও পাহাড়ে উঠে কিছুক্ষণ হৈ হল্লা করে , তাঁর গাড়ীর দু’টো চাকাতে ফুটো করে হাওয়া বের করে চলে আসল । মন্ত্রী সাহেব দু'দিন চট্টগ্রামে ছিলেন । আমার সঙ্গেও তাঁর দুই তিন বার সাক্ষাৎ হল । নানা কথা বার্তার মধ্যে তিনি একবারও ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সম্পর্কে আমাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করলেন না , যদিও পুলিশ প্রধান ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছাত্রদের এ দুষ্টামির পেছনে আমার উষ্কানী আছে বলে তাঁকে নিশ্চয়ই বলেছিলেন । বিদায়ের দিন রাত্রে ষ্টেশন প্ল্যাটফর্মে প্রায় বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন । মন্ত্রী সাহেব তাঁর কামরায় উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন । আমি যেতেই ইশারা করে তিনি আমাকে তাঁর কাছে ডাকলেন । আমি পাদানীর উপর দাঁড়াতেই তিনি তাঁর দু'হাত আমার কাঁধের উপরে রেখে হেসে হেসে বললেন , “ তোমার সব কথাই আমি জানি । ভাগ্যদোষে ছোট চাকরী করতে হলেও তোমার ব্যক্তিগত প্রভাব ও প্রতিপত্তির কথা আমি দু'দিন ধরেই আমি শুনেছি । আর আমি ডি . পি . আইকে শীঘ্রই তোমার প্রমোশন দেবার কথা বলেছি । ” সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ী ছেড়ে দিল । ডি , পি , আই ও ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমার সঙ্গে মন্ত্রীর খাতির আছে জেনে তাঁদের কথা বার্তার সুর বদলে ফেললেন ।। ডি.পি , আই , আমাকে ষ্টেশনেই বললেন , ' সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশের বিরুদ্ধে আপনাকে আমি এই বিভাগে সেকেও ইন্‌সপেক্টার করতে পারি না , তবে আমি কথা দিচ্ছি আপনি বরিশাল রেঞ্জে যেতে রাজী হলে আমি আপনাকে এক বৎসরের মধ্যে বিভাগীয় ইন্সপেক্টর করে এখানে নিয়ে আসব । আপনি রাজী হউন ” । আমি বললাম , “ সেকেন্ড ইন্‌সাপেক্ট্রারী করবার জন্য আমি চট্টগ্রাম ছাড়তে পারি না । প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে পুলিশ দলের সঙ্গে দেখা হতেই এডিসনাল পুলিশ সুপার বন্ধুবর কাদেরী সাহেব হেসে হেসে বললেন , “ চাটগাঁর এ গোলমালের জন্য আপনাকে জেলের বাইরে থাকতে দেয়া উচিত নয় , " আমিও উত্তর দিলাম , “ তা ত বটে , তবে তার আগে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার করবার ভার যাদের উপর ন্যস্ত , তাদরে অক্ষমতার জন্য ডিসমিস করে ' আন্দামানে পাঠিয়ে দেয়া উচিত । আনোয়ারুল হক সাহেব অতি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য করলেন । ছাত্রদের ব্যবহার বাস্তবিক অত্যন্ত গর্হিত । " ইতিপূর্ব্বেই ডি.পি.আই ডাক্তার কুরতে খোদা সাহেবের আমার এক হাত হয়ে গিয়েছিল । তিনি আসবার মাস তিনেকের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে । বঙ্গ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গেই এখানে ইনকামট্যাক্স কমিশনার নিযুক্ত হয়ে আসেন আমার এক বন্ধু মাহতাব উদ্দিন সাহেব । তাঁর সঙ্গে ডাঃ কুদরতে খোদার ভাব ছিল । একদিন সকালবেলা মাহতাব সাহেবের সঙ্গে স্কুলের দিকে আসবার সময় তিনি আমাকে নিয়ে ডি.পি.আই এর বাসায় ঢুকলেন । ঢুকেই তিনি বললেন , “ একে আপনি চেনেন ? আমি তাড়াতাড়ি বললাম , বন্যা - ত্রাণ সমিতির কার্য নির্ব্বাহক কমিটির সভায় তাঁকে আমি দেখেছি এবং আলাপ হয়েছে । এখানে বলে রাখা ভাল স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের সমুদয় গেজেটেড অফিসার ডি.পি.আই সাহেবের বাসায় ও অফিসে সময়ে অসময়ে ভিড় জমাত । তাঁদের মধ্যে এক প্রফেসার ও এক সেকেণ্ড ইন্‌সপেক্টার তাঁর বাড়ীর কাজে কর্মে সহায়তা করে তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন । আমি কিন্তু কোনদিন যাই নি । এ বন্যা - ত্রাণ সমিতির সভাপতি ছিলেন জেলা জজ জনাব ফজলে আকবর সাহেব ( যিনি পরে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসর নেন । ) আমি ছিলাম সহ সভাপতি । জেলার সমগ্র অঞ্চলের সাহায্য বিতরণের ভার ছিল আমার উপর । কাজেই স্কুলের কাজ করে যে সময়টুকু পাওয়া যেত , তা বন্যা - ত্রাণ সমিতির কাজেই ব্যয়িত হত । এ কাজের মাধ্যমে জেলা জজের সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা জন্মে এবং বহুদিন পর্যন্ত ইহা বজায় ছিল । উপরোক্ত সেকেও ইন্সপেক্টার সাহেব একদিন বিকেলে আমার নিকট একটা শিল্প পাঠিয়ে জানালেন যে কোন এক আবশ্যকীয় বিষয়ে পরামর্শের জন্য ডি.পি.আই , সাহেব সেই রাত্রে আমাকে তাঁর বাসায় যেতে বলেছেন । আমি তাঁকে বলে পাঠালাম যে , সে রাতে আমি রিলিফের কাজে ব্যস্ত থাকব । পরদিন সকালেই যাব । পরদিন সকালে আটটার সময় পিওনকে সাথে করে ডি.পি.আই , এর বাসায় গিয়ে দেখি বৈঠকখানার দরজা বন্ধ । জানালা দু'টি অর্ধখোলা । আমি কয়েকবার গলা খাঁকারী দিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলাম । প্রায় পাঁচ মিনিট চলে গেল । ভিতরে কোন সাড়া - শব্দ নেই । অথচ আমার সে সময় যাবার কথা ছিল । জানালার ফাঁকে দেখতে পেলাম ডি.পি.আই সাহেব আর চট্টগ্রাম কলেজের ভাইস প্রিন্সিপল জনাব আবদুল হাই সাহেব মিলে কি একটা লেখাপড়ার কাজ করছেন । পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেও সাড়া না পেয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমি দক্ষিণ ধারে যে দরজাটি খোলা ছিল সেখানে গিয়ে বললাম , " May 1 come in sir ? " ডি.পি.আই , সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বললেন , “ Yes ” তাঁরপর আবদুল হাই সাহেবের নিকট আমি শুনতে পাই মত মন্তব্য করলেন : I do not like to be disturbed while reading the Holy Quoran . " এসব কথা শুনে এবং তাঁর মুখের ভাব দেখে আমি যে সোফায় বসেছিলাম , সেটাতে যেন আগুন ধরে গেল । আমার পায়ের নখ - প্রান্ত থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ক্রোধের বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল হাই সাহেব আমাকে চিনতেন এবং শহরে আমার জনপ্রিয়তার কথাও জানতেন । তিনি অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে বললেন , স্যার আমার একটা বিশেষ কাজ আছে ; জুমার আগেই সারতে হবে । অনুমতি করেন ত যাই । ” এ বলে তিনি বিদায় নিয়ে আমার চেহারা দেখে একটা আসন্ন ঝড়ের সংকেত অনুমান করে বিমর্ষ মুখে বের হয়ে গেলেন । ডি.পি.আই. সাহেব সামনে আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং রাগের মাথায় ইংরেজী বুলি ছাড়লাম । তার মর্থ হল এরূপ " কাল বিকেলে কি সেকেও ইন্সপেক্টর মারফৎ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমাকে তিনি জরুরী সংবাদ পাঠান নি ? তিনি বললেন , কই না ত ! আমি ত কিছুই জানি না । " উত্তরে বললাম , “ তাহলে আপনার সঙ্গে আমার অর্ধেক বিবাদ রফা হয়ে গেল । অবশিষ্ট অর্ধেকের জন্য দ্বিতীয় ইন্সপেক্টরকে আমার নিকট সন্তোষজনক জবাবদিহি করতে হবে নতুবা চট্টগ্রাম ছাড়তে হবে । আর প্রথম অর্ধেক ক্রোধের কারণ হচ্ছে আপনার ঘরে , আমার ব্যক্তিগত অপমান । আপনি এখানে এসেছেন তিন মাস হল । শিক্ষা বিভাগের সব কর্মচারীরা আপনার এখানে এসে ধর্ণা দেয় । কিন্তু আমাকে কি কখনও আসতে দেখেছেন আল্লাহ যাঁদের আমার উপরে স্থান দিয়েছেন , বিনা আহ্বানে কখনও আমি তাঁদের ধারে কাছেও যাই না । বিশেষ কাজ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট , কমিশনারের বাড়ীতেও না । আমি আপনার অধীনস্থ চাকুরিয়া হলেও এ শহরের কোন ব্যক্তি তিনি যত বড়ই হোন না কেন , আমার সঙ্গে একপ ব্যবহার করতে পারতেন না । আচ্ছা মাফ করবেন , আমি যাই । সেকেও ইন্সপেক্ট্রারকে একটু দেখতে হয় । ” আমি যে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছি তা বুঝে তিনি তাড়াতাড়ি এসে আমার হাত ধরে বসালেন এবং বললেন , “ নিশ্চয়ই সেকেও ইন্সপেক্টারের বুঝতে ভুল হয়েছে । শিক্ষা বিভাগের লোক হয়ে একজন হেড মাষ্টারকে নিজের কাজে বাসায় ডেকে পাঠাব , আমি এত অবুঝ নই । একবার বলেছিলাম বটে , আমার যে ছেলে দশম শ্রেণীতে পড়ে তাকে আপনার স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার কথা । সে উদ্দেশ্যে আজও ছেলেকে আপনার কছে পাঠাবার জন্য একজন লোক এনে বাসায় বসিয়ে রেখেছি । ” এ বলে তিনি তার ছেলের নাম ধরে ডাকলেন । ছেলে আসতেই বললেন , “ সালাম কর ইনি মুসলিম হাইস্কুলের হেডমাষ্টার । ” তারপর ছেলে সম্বন্ধে নানা কথা আরম্ভ করলেন । ছেলেকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করব বলে জানিয়ে চলে আসার সময় তাকে দুঃখ করে বল্লাম , “ ভাগ্য দোষে আমি আজ হেডমাষ্টার , না হলে আমিও একজন উঁচুদরের কর্মচারী হতে পারতাম । আল্লাহ ব্যতীত কারও কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই । কাজেই কারও কাছে আমি যাইও না , মাথাও হেট করি না । মাষ্টারী করি দেশের উপকারের জন্য , টাকার জন্য নয় । " তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন । আমি তাঁকে সালাম দিয়ে চলে আসলাম । ১৯৪৯ ইংরেজীর মাঝামাঝি আমি চট্টগ্রাম বিভাগে সেকেণ্ড ইন্সপেক্টার পদে নিযুক্ত হওয়াতে আমার শিক্ষক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে । আমি ফুল বাগানের মালির পদ ছেড়ে অরণ্য বনের প্রহরী বনে গেলাম । এ পেশা পরিবর্তনে আমার স্ত্রীর আগ্রহই সর্ব্বাপেক্ষা বেশী ছিল । তাঁর যুক্তি হল প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টারকেও লোকে মাষ্টার সাহেব বলে , সরকারী স্কুলের হেডমাষ্টারকেও বলে মাষ্টার সাহেব । আর ডেপুটি মুন্সেফদের গৃহিনীরা মাষ্টারদের গৃহিনীদের তেমন পাত্তা দেন না । তবে অন্ততঃ তার ও আমার বেলায় এ সব কথার কোন অর্থ ছিল না । কারণ আমাদের মেলামেশা ছিল তাঁদের উপরের স্তরের চাকুরিয়াদের সঙ্গে । আমি তাকে ঠাট্টা করে বলতাম , “ তুমি ভুলে যাও কেন যে , চট্টগ্রামে যে তিনজন লোক সবার চেয়ে বেশি পরিচিত , তারা তিনজনেরই খ্যাতি মাষ্টার হিসেবেই । তাঁরা হলেন কাজেম আলী মাষ্টার , আমান আলী মাষ্টার আর আবদুর রহমান মাষ্টার । এ দেশে ইন্সপেক্টারের কোন পাত্তা নেই । শত শত ছাত্রের অনেকেই বড় বড় লোক হয়ে পথে - ঘাটে , মেলা - মজলিশে অসংখ্য লোকের সামনে পায়ে হাত দিয়ে মাষ্টারদের সম্মান  দেখান । আর অন্য লোকেরা এ সব লোককে নত হয়ে অভিবাদন করে । মাষ্টারের এ সম্মানের মূল্য কি কম ? " কিন্তু ভবি ভুলবার নয় । প্রায় আট বৎসর ইন্সপেক্টারী করার পর অবসর গ্রহণ করলেও জেলায় আমি হেডমাষ্টার নামেই পরিচিত ।
লেখকঃ
জনাব আবদুর রহমান
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, গভ. মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়।

Join Our Community Now

Join Community